মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল: “বাপ চাচার মুখে যুদ্ধের কথা শুনছি। চোখে দেখি নাই। যুদ্ধে নাকি গোলাগলি শুরু হইলে পালাইয়া ঝোপ জঙ্গল আশ্রয় নিতো। মাটির সাথে শুইয়া থাকতো। আইজ বুঝছি অমুন বিপদে মানুষ বাঁচার জন্য কি করে।” এমনিভাবে বলছিলেন মুন্সীগঞ্জের সদরের মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের রাজারচর গ্রামের মর্জিনা বেগম (২৯)। পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে নিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাজারচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্র দখলের চেষ্টায় মুহুর্মুহু ককটেলের বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হচ্ছিল। একেরপর এক ককটেল এসে পরে ভোট কেন্দ্রে।
আর প্রকট শব্দ ধুয়া, বারুদের গন্ধ, আর ঝলসে যাওয়ার দৃশ্য। কেন্দ্রের ভেতরে প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং, পুলিং অফিসার, আনসার এবং এজেন্ট অনেকেই মেঝেতে শুয়ে পরেন আত্মরক্ষায়। প্রাণ বাঁচাতে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলেন তখন। এই সময় কেন্দ্রের কক্ষের ভেতরে আটকা পারেন মর্জিনা। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি দরাজা বন্ধ করে রাখা স্কুল ভবনের পেছনের অংশের জানালা ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসেন। এই সময় আহত হন মর্জিনা। কেন্দ্রের পাশে বাড়ি তার। সেখানেও পড়ছিল বোমা। পরিবার পরিজন নিয়ে কি করবেন দিশা পাচ্ছিলেন না মর্জিনা। একই অবস্থায় পরেন নানা বয়সী শত শত নারী-পুরুষ ভোটার। এই অবস্থা চলে প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং ম্যাজিস্ট্রট এসেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। বোমা হামলাকারীদের ধাওয়া দেন একদল পুলিশ।
কিন্তু একপর্যায়ে হামলাকারীরাই পাল্টা ধাওয়া করে পুলিশকে। পরিস্থিতির শিকার সহকারী পুলিশ সুপার আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, শুধু সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় আট জনের পুলিশের দলটি নিয়ে বেচেঁ আসি। বিলে (ধান-পাটের জমি) ধাওয়া দেয়া হয়। পেছনে কেন্দ্রের পাশের সেতুর উপরে ছিল বিজিবি। তারা যেই চলে গেল, পুলিশের সংখ্যা কম দেখে সেই পাল্টা হামলা করলো বোমাবাজরা। এই সময় পুলিশ শতাধিক রাউন্ড গুলি ছুড়লেও হামলাকারীও গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটনায়। এর আগে ভোট কেন্দ্রে শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। হেলম্যাট থাকায় প্রাণে রক্ষা পেলেও এসময় সোহেল (৩২) নামে এক পুলিশ কনস্টেবল আহত হয়। সাড়ে ১০টার দিকে একবার ভোট গ্রহন আবার শুরু করলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় আবার বন্ধ করা হয়।
পরে বেলা ১১টার দিকে আবার ভোট গ্রহন শুরু হয়। ২ হাজার ৫৫৬ ভোটারের এই কেন্দ্রে এত কিছুর পরও আবার ভোটারের লম্বা লাইন বিস্মিত হওয়ার মত। গ্রামটির ৫৫ বছরে শাহনাজ বেগম তিন বার ভোট দিতে এসে ফিরে যান। চারবারের মাথায় বেলা ২টার দিকে ভোট দেন এই নারী। এই সময় নারী লাইনে ভোট দেয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন মালা আক্তার। প্রথমবারের মত ভোট দিতে এসেই নানা বিড়ম্বনা। সমাজ কর্মে ¯œাতক সম্মানর দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রী বলেন তারপরও জীবনের প্রথম ভোটটি প্রয়োগ করতে চাচ্ছি। এই লাইনের আরও একটু সামনে ছিলেন আরেক নতুন ভোটার গৃহিনী ফাতেমা বেগম। তাদের প্রশ্ন ভোট নিয়ে এত হাঙ্গামা কেন? কেন্দ্র ঘেষা রাজারচর জামে মসজিদেও বোমা এসে পরে। ঝলসে যায় দেয়াল। প্রত্যক্ষদর্শী মসজিদটির পেশ ইামাম মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ বিস্ময় প্রকাশ করেন।
এই কেন্দ্রে পোলিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা প্রিয়াঙ্কা পাল (২২) এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। সুধারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন চাকুরী হওয়া প্রিয়াঙ্কা যেন নতুন জীবন পেয়েছেন। বোমা আর বোমা। সেটি আবার তাদের ভবনটি লক্ষ্য করেই। মেঝেতে পরে থেকে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন তারমত সিপাহিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লিজা আক্তার, সোলারচর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আয়শা আক্তারসহ অন্যান্য কর্মকর্তরা প্রাণ রক্ষার চেষ্টা চালান। প্রিয়াঙ্কা বলেন, বিভৎস স্মৃতি। এই ক্ষনটি মনে করতে চাইনা, জীবন থেকে বাদ রাখতে পারলেই ভালো।
কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসার উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার মো. আসাদুজ্জামান জানান, এমন ঘটনা ভাবতেও পারিনি। এভবে একেরপর এক বোমা মারতে পারে বিশ্বাস হয় না। এই কেন্দ্রে ভেতরে আটকা পরা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী জিয়াসমিন আক্তার বলেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী রিপন পাটোয়ারীর লোকজন এই ঘটনা ঘটায়। একই চিত্র ছিল পাশের চরডুমুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রে একই ভাবে আটকা পরেন তার বোন প্রার্থী মহসিনা হক কল্পনা। পরিস্থিতি কিছু নিয়ন্ত্রণে আসলে মোবাইলে বোনের সাথে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন জিয়াসমিন।
তবে বর্তমান চেয়ারম্যান রিপন পাটোয়ারী এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, এই সহিংসতার সাথে তার কোন সম্পৃৃক্ততা নেই। সহিংসতামুক্ত শান্তিপূর্ণ পুন:ভোট গ্রহনের জন্য রির্টানিং অফিসারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। অন্যদিকে বিদ্রোহী প্রার্থী মহসিনা হক কল্পনা বলেন, নিশ্চিত পরাজয় জেনে কেন্দ্র বন্ধ করতে সন্ত্রাসী ভাড়া করে এসব হাঙ্গামা চালায় রিপন পাটোয়ারী।
এই ইউনিয়নের চরডুমুরিয়া কমিটিউনিটি সেন্টার এবং মুন্সিকান্দি প্রাথমক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও বোমা হামলা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোর ভোটারদের পাশপাশি ভোট গ্রহন করতে আসা কর্মকর্তারাও পরেছিলেন বিপাকে। কমিটিনিটি সেন্টার কেন্দ্রের পোলিং অফিসার সহকারী শিক্ষক মৌতিষা ভট্রাচার্য প্রশ্ন করেন, এই যুগেও এভাবে বোমা ফাটাতে? আর চরডুমুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পোলিং অফিসার উর্মি পালও আতঙ্কিত। কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসার রিকাবী বাজার উচ্চ বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক হৃদয় কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, সকাল থেকে ভালো ভোট হচ্ছিল। ভোটারের লম্বা লাইন ছিল।
কিন্তু ১০টার পরেই মহুর্তের মধ্যেই পাল্টে গেলো। তার মতে প্রায় আড়াই শ’ বোমা ফুটেছে তার কেন্দ্র রক্ষ্য করে। নতুন স্কুল ভবনটির দেয়ালেও যেন ক্ষত থাকছে। এই কেন্দ্রের বাইরে দায়িত্বে থাকা এসআই ফয়সাল বলেন, শুধু তিনিই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৪৫ রাউন্ড ফাকা গুলি করেন। এই কেন্দ্রে পোলিং এজন্ট ছিলেন ঝুনু বেগম। তার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ থাকলেও সাহস করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, চরাঞ্চলের এই মানুষগুলো অনেক সংগ্রামী। সংগ্রাম করেই যেন বাঁচতে হচ্ছে। নয়তো এত বোমার মধ্যে ভোট-ঠোট দিতে কেউ আসতো না। সবাই মনে করছে বাঁচতে হলে এভাবেই সব প্রতিকুলতা মোকাবেলা করতে হবে।
এদিকে গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর ইউপির ভিটিকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র ব্যালট পেপার ছিনাতাইয়ের স্থগিত করা হয়েওছে। তবে মুন্সীগঞ্জে শনিবার অনুষ্ঠিত অন্য ১৩০ কেন্দ্রে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণভাবে ভোট গ্রহন হয়ছে। এমনি একটি আধারা ইউপি। মেঘনা পারের এই উনিয়নের চিতলিয়া কমিউনিটি সেন্টারে ভোট দিতে আসেন সবিতা রানী মন্ডল। তিনি বলেন, এখানে শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে।
এসব বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল হালিম জানান, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছে। আর সেকারণেই কোন প্রার্থীই কেন্দ্র দখল করতে পারেনি। কিছু সময়ের জন্য ভোট গ্রহন বিঘিœত হলেও পরে আবার ভোটারা নির্বিগ্নে ভোট দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ফজলে আজিম জানান, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও ভোটারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছে। বিশৃঙ্খলার দায়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ২০ জনকে কারাদন্ড এবং অর্থ দন্ড দিয়েছে।
জনকন্ঠ
Leave a Reply