যুদ্ধের পর রাতের আঁধারে থেকে পালাল হানাদার বাহিনী

কাজী সাবি্বর আহমেদ দীপু: ধলেশ্বরী নদীতে গানবোটে বসে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের আরেকটি দল চেষ্টা করছে রতনপুরে প্রবেশ করার। আরেকটি দল এগিয়ে আসছে মুন্সীগঞ্জ-রামপাল সড়কপথে রামপালের দিকে। এই ত্রিমুখী আক্রমণকে প্রতিরোধ করে মুন্সীগঞ্জকে একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর নিজেদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি করে তোলে মুক্তিযোদ্ধারা। মুন্সীগঞ্জের এই যুদ্ধ সেখানকার পাকিস্তানি সেনাদের দুর্বল করে ফেলে। কোনো যুদ্ধে না জড়িয়ে আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বন করে তারা। ১১ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ মুক্ত হয় চূড়ান্তভাবে।

মুন্সীগঞ্জের সর্বশেষ ৪ ডিসেম্বরের সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা (এফএফ) আনোয়ার হোসেন অনু বলছিলেন কীভাবে সেদিন সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। যুদ্ধটি হয়েছিল মুন্সীগঞ্জ শহরের অদূরে রতনপুর ও এর আশপাশে। এ যুদ্ধে জেলার বিভিন্ন এলাকার এক হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের তিনটি বড় দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।

আনোয়ার হোসেন অনু বলেন, ‘গানবোট থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে পাকিস্তানি সেনারা সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের লক্ষ্য করে মুহুর্মহু গুলিবর্ষণ করলেও সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না। এ সময় মিত্র বাহিনীর বিমান বহরের হামলার ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসেন। তিনটি গানবোট বিধ্বস্ত হওয়ার পর পাকিস্তানিরা ভীত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সুবিধাজনক না হওয়ায় তারা পিছু হটতে শুরু করে। এ যুদ্ধে তিন পাকিস্তানি সেনার লাশ পাওয়া যায়। ১৪ থেকে ১৫ জন সাধারণ নিরীহ মানুষও শহীদ হন।’

তিনি বলেন, ‘৪ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ও মিত্র বাহিনীর বিমান বহরের হামলার মুখে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে মুন্সীগঞ্জ শহরের হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পে এবং ধলেশ্বরীর উত্তর প্রান্তের চরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা বিচ্ছিন্নভাবে ধলেশ্বরী নদী সংলগ্ন নয়াগাঁও এলাকায় মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এভাবে তারা মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে পিছু হটার কৌশল নেয়। ১০ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে প্রচণ্ড শীতের ঘন অন্ধকারে পাকিস্তানি বাহিনী মুন্সীগঞ্জে তাদের সুরক্ষিত দূর্গ হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায়। আমরা তা বুঝতে পারি ১১ ডিসেম্বর ভোরে। এর পরই জয় বাংলা স্লোগানে আর বিজয় মিছিলে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে মুন্সীগঞ্জবাসী।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় মুন্সীগঞ্জ, টঙ্গিবাড়ী ও গজারিয়া_ এ তিন থানার বিএলএফের যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোহাম্মদ হোসেন বাবুল জানান, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধের আগে ১৪ নভেম্বর রাতে মুন্সীগঞ্জ থানা দখল করার জন্য রামপাল এনবিএম উচ্চ বিদ্যালয়সহ একাধিক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরে ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা সাতটি দলে ভাগ হয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।

সেপ্টেম্বর মাস থেকেই মুন্সীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণ ও সম্মুখযুদ্ধ দুটোতেই নাজেহাল করতে থাকেন পাকিস্তানি সেনাদের। এ সময় শ্রীনগরের বাড়ৈখালীর শিকরামপুর হাটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। নবাবগঞ্জ থেকে তিনটি গানবোট বোঝাই পাকিস্তানি সেনা শিকরামপুরে পেঁৗছলে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে সেগুলো নদীতে ডুবিয়ে দেন। শতাধিক পাকিস্তানির মৃত্যুতে ভীত হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ২৪ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন, শহীদুল ইসলাম সাঈদসহ অন্যরা লৌহজংয়ের গোয়ালীমান্দ্রায় সফল অভিযান চালিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। ২৫ সেপ্টেম্বর সিরাজদিখানের সৈয়দপুর লঞ্চঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত হয় পাকিস্তানি ফ্লাইট সার্জেট ওমর গ্রুপের ৯ সৈনিক। এ সময় পাকিস্তানিদের সহযোগীদের ওপরও কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

অক্টোবর মাসে ধলাগাঁও বাজারে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় পাকিস্তানি সেনাক্যাম্প ঘিরে দুই ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ করে। এতে তিন পাকিস্তানি নিহত হয়। ৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা টঙ্গিবাড়ী থানা দখল করে। মুক্তিযোদ্ধারা ৮ নভেম্বর প্রথম সিরাজদীখান আক্রমণ করে। তবে দ্বিতীয় দফা আক্রমণে ১৯ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে আত্মসমর্পণ করে। এ ঘটনায় মনোবল বেড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৬ নভেম্বর ১১৫ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধা একযোগে আক্রমণ চালিয়ে মুন্সীগঞ্জ থানাসহ শহর সাময়িকভাবে দখল করে নেয়। তারা পরিকল্পিতভাবে ৬-৭টি দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ অব্যাহত রাখে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের বিভিন্ন ক্যাম্প ত্যাগ করে দলে দলে ধলেশ্বরী নদীর তীরে চলে যায়। নভেম্বরের শেষের দিকে গজারিয়ার বাউশিয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ চালান। এতে পাকিস্তানি বাহিনী একপর্যায়ে আত্মসমর্পণ করে। তবে কমান্ডার নজরুল ইসলাম স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে গেলে আত্মসমর্পণকারী এক পাকিস্তানি সেনা গুলি চালায়। এতে শহীদ হন তিনি।

মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন অনু সমকালকে জানান, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সফলতার খবর আসতে শুরু করায় তারাও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে থাকেন। জেলার বিভিন্ন স্থানে গোপনে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা পৃথক পৃথক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার ধলাগাঁও, রামপাল, রতনপুর, মিরকাদিমসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হতে থাকে। সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা চারদিকে অবস্থান নেন, যাতে পাকিস্তানি সেনারা রামপাল, ধলাগাঁও ও রতনপুর এলাকাসহ গ্রামের ভেতরে ঢুকতে না পারে।

মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি যাতে ঢুকতে না পারে সে জন্য আমরা মুন্সীগঞ্জ-রামপাল সড়কের বাইন্নাবাড়ী এলাকার একটি ব্রিজ ভেঙে ফেললাম। এরপরও পাকিস্তানি সেনাদের তিনটি বড় দল তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে রতনপুর ও রামপালের দিকে আসার চেষ্টা করে। আমি ও এসপি কাজী আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে এক থেকে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা তখন শহরের কাছেই রতনপুর এলাকায় অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করি। আমাদের এই প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সেনারা ব্যর্থ হয় রতনপুর এলাকায় ঢুকতে।’

আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘রতনপুর এলাকায় ঢুকতে না পারলেও পাকিস্তানি সেনারা মুন্সীগঞ্জ-রামপাল সড়কপথে রামপাল এলাকায় ঢুকে পড়ে। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল অবলম্বন করে তাদের লক্ষ্য করে গুলি না চালিয়ে আপাতত নীরব থাকার নীতি অবলম্বন করে। এতে পাকিস্তানিরা মনে করে, রামপাল এলাকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই। তারা নির্বিবাদে সেখানে টহল দিতে থাকে। যে রাজাকাররা তাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আসার খবর দিয়েছিল, তাদেরও গালাগাল করে তারা।’ তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন নীরব না থাকলে পাকিস্তানি সেনারা আগুন জ্বালিয়ে গ্রামবাসীকে হত্যা করতে থাকত, রামপালকে ধ্বংস করে ফেলত।’

আনোয়ার হোসেন অনু বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা যাতে মুন্সীগঞ্জের গ্রামগুলোতে ঢুকতে না পারে সে জন্য আমরা মুক্তারপুর এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। মিরকাদিম নৌবন্দরে গিয়ে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে বলি। কেননা, পাকিস্তানি সেনারা ধলেশ্বরী নদীতে গানবোটে টহল দিত।’

সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.