মাওয়া যেন মিনি কক্সবাজার

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল ॥ চিক চিক বালু। ঢেউ এসে আসছে পড়ছে। এই বালু পথেই হাঁটছে শত শত মানুষ। খালি পায়ে পথ চলছে বহু রমনীও। যতদূর চোখ যায় পদ্মার রূপ ছড়িয়ে আছে। আর পদ্মা তীরের জনপদগুলো যেন ছবির মতো। ঘন সবুজ নানারকমের গাছ পালায় ভরা। শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। সব মিলিয়ে মিনি কক্সবাজের রূপ নিয়েছে এখন মাওয়া। আর সূর্যাস্ত দেখা যেন আরেক ভাল লাগা। আর ভোরে সূর্যদয়ের রূপটিও এখান থেকে বেশ দেখায়। তাই ক্রমেই পর্যটক বাড়ছে। এটি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পুরাতন মাওয়া ফেরিঘাট থেকে মাওয়া মৎস্য আড়তের দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত ৩শ’ মিটার দীর্ঘ এলাকা। এর আশেপাশে এই মিনি সমুদ্র সৈকতের রূপ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এই অংশ এখন পর্যটকদের খুববেশি আকৃষ্ট করেছে। শুধু সমুদ্র সৈকতের ছন্দ আর প্রকৃতিক সৌন্দর্যই নয়। এখান থেকে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুও খবু ভাল করে দেখা যাচ্ছে।

নদী তীরে ঘুরে বেড়ানোর পাশপাশি তাই অনেক পর্যটক রূপালি পদ্মায় স্পিডবোট নিয়েও পাড়ি দিচ্ছেন এই এলাকা। ঢেউয়ে মাঝেই পদ্মার বুকচিড়ে পর্যটকদের নিয়ে বেড়াতে স্পিডবোটগুলোও এখন অপেক্ষা করছে। প্রকৃতির এক বিশেষ রূপ যেন ভর করেছে এখানে। বিশেষ করে নদী শাসনের কারণে এবং রক্ষাবাঁধ তৈরি করার পর তীরের চেহারাই গেছে পাল্টে। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরের এই মিনি কক্সবাজার দেখতে যাই প্রতিদিনই সমানে পর্যটক আসছে। আর ছুটির দিনে এই সংখ্যা কয়েকগুন বেড়ে যাচ্ছে। বর্ষা বিদায়ের পর শরত আসতেই এখানকার রূপে যেমন জৌলুস বেড়েছে, তেমনি পর্যটকও অনেকে বেড়ে গেছে। সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো পদ্মা নদীর অপরূপ জলরাশি। বিশাল জলরাশিতে। ¯্রােত আর ঢেউয়ের ছন্দের বিশেষ শব্দ। পদ্মায় হেলেদুলে ভেসে বেড়ানো জেলেদের নৌকা। পদ্মার তীরে সুন্দর বালুপথে ঘুরে বেড়ানো। সব মিলে কিছুক্ষণের জন্য আপনার মনে হবে আপনি মাওয়ায় নয়, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে আছেন। মূলত এ কারণেই এখন অনেকে পুরনো মাওয়া ফেরি ঘাটকে বলে থাকেন ‘মিনি কক্সবাজার’।

একসময় এই ফেরিঘাট ছিল রাতদিনের ব্যস্ততা। লাখো মানুষ পারাপার হতো এই ঘাট দিয়ে। হাজার হাজার যানবাহনের দীর্ঘ লাইন ছিল। দোকানপাটের অভাব ছিল না। কিন্তু নদী ভাঙ্গার কারণে সবই পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ঘাট সরিয়ে নেয়া হয়। পরবর্তীতে পদ্মা সেতুর নির্মাণের কারণে এই ঘাট মাওয়া থেকেই সরিয়ে নেয়া হয় তিন কিলোমিটার দূরের শিমুলিয়া ঘাটে। কিন্তু সেই ঘাট যে এখন আরেক ভিন্ন রূপ লাভ করেছে। তা হয়তো অনেকেই জানে না। এই পুরনো ফেরিঘাট এখন নির্মল ভাল লাগা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির এক বিশেষ দান, ভাল লাগা। তাই রাজধানীর ইট পাথরের যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা ফেলে অনেকেই এখানে রিফ্রেশ হচ্ছেন। তাই পরিবার পরিজন নিয়ে এখানে এসে সময় কাটাচ্ছেন। পর্যটকদের পদচারণা বেড়ে যাওয়ায় এখন এই মিনি কক্সবাজার ঘিরে দোকানপাটও উঠতে শুরু করেছে। নানারকমের ফেরিওয়ালাও দেখা যাচ্ছে।

আর অনেকে ভোরে আসছেন মাওয়া মৎস্য আড়তে ফ্রেশ এবং ফরমালিনমুক্ত মাছ যেমন কিনে নিচ্ছেন বৃহৎ মৎস্য আড়ত থেকে একইসঙ্গে সূর্যদ্বয়ও প্রত্যক্ষ করছেন। ভোরের সেই দৃশ্য না দেখলে বিশ^াস করা যাবে না। ঢাকার বনানী থেকে আসা শাহরিয়ার হোসেন জানান, তিনি ভোরে নিজের প্রাইভেটকার নিয়ে এখানে এসছিলেন শুক্রবার। পদ্মার ইলিশ, আইরসহ নানারকমের মাছ কিনেছেন আবার সূর্য ওঠার অপরূপ সৌন্দর্যও উপভোগ করেছেন। তিনি বলেন, এটি মিনি কক্সবাজার কবূরন আর পতেঙ্গা, যাই বলুন না কেন এই এখানকার সূর্যদ্বয়ের রূপ কোন এলাকা থেকেই খারাপ বলা যাবে না।

আবার অনেকে দিনের বেলায় আসছেন। শিমুলিয়া ঘাটে ইলিশ কিনে কাটাকাটির পর তাৎক্ষণিক রান্না খেয়ে এরপর পাশেই এই মিনি কক্সবাজারে আসছেন। সেখানে সুন্দর বিকেল এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করছেন।

ঋতুতে এখন শরত। ঝির ছির বৃষ্টি থাকে মাঝে মধ্যে এর মধ্যে ভাল লাগা জানালেন মগবাজার থেকে আসা বাঁধন রহমান। তিনি এসছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমাদের দেশ আসলেই সোনার বাংলা। এত সুন্দর রূপ আর কোন দেশের আছে। নদী, নৌকা, রাখাল আর পদ্মা তীরের পশুপাখির সৌন্দর্যও কম কিসে।

তাই এখন পদ্মাপাড়ে পর্যটকদের ঢল নামে। পর্যটকদের ভিড় ছড়িয়ে পড়ে মাওয়া রিসোর্ট ও পদ্মা রিসোর্টেও ভিড় বাড়ছে। পদ্মার কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই ভিড়। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে পর্যটকরা আসেন সপরিবারে। আবার কেউ আসেন একাকী এবং প্রেমিকযুগলরা আসেন একে অন্যের হাত ধরে। উপভোগ করেন ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ, নদীতে গোসল করা আর পড়ন্ত বিকেলের অভাবনীয় দৃশ্য উপভোগ করেন। পদ্মা সেতুর কাজের জন্য মাওয়া চৌরাস্তা বরাবর দক্ষিণের পদ্মা সংরক্ষিত থাকলেও পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় ছড়িয়ে পড়ে সংরক্ষিত এলাকার আশপাশে। শুধু এই পদ্মাপাড়ই নয়, পর্যটকদের ভিড় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে লৌহজংয়ের ঘোদৌড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আর পশ্চিমে জসলদিয়া।

এই বিষয়ে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ কাবিরুল ইসলাম খান বলেন, এখানে পর্যটকদের ভিড় বৃদ্ধির কারণে স্থানীয়ভাবে নিরাপত্তাসহ সকল সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান ঝিলু বলেন, মাওয়া যেন এখন ধীওে ধীরে মিনি কক্সবাজারে পরিণত হচ্ছে। মাওয়া পুরাতন ফেরিঘাট থেকে মাওয়া মৎস্য আড়তের দক্ষিণে পদ্মাপাড়ের এই ৩শ’ মিটার এলাকা এখন ভ্রমণ পিয়াসীদের কাছে পদচারণায় মুখর হয়ে উঠছে। দিনদিন বাড়ছে এ এলাকার জনপ্রিয়তা। এর প্রধান কারণ এখান থেকে দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ও স্প্যান দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, নির্মল বাতাস গ্রহণ করে পর্যটকেরা নদীরপাড় ঘেষে অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারে। সর্বোপরি নদীর কূলে নেমে কক্সবাজারের সমুদ্রের মতো উদ্দাম করে সাঁতার কাটা যায়। সাঁতার কাটার জন্য পর্যটকেরা রীতিমতো সঙ্গে করে জামাকাপড় নিয়ে আসে।

জনকন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.