শহিদ বাবা আদম মসজিদ

কাউসার লাবীব : জীর্ণশীর্ণ ছাদ। ছয়টি গম্বুজ। ৪ ফুটের প্রশস্ত দেয়াল। দেয়ালের গায়ে আবির রঙের ইট। দশ থেকে পাঁচ ইঞ্চির ইট। ইটের সঙ্গে ইটের মিলনে গড়ে তোলা একটি স্থাপনা। দৈর্ঘ্যে ৪৩ ফুট ও প্রস্থে ৩৬ ফুট।

নির্মাণ নকশা বা স্থাপত্যকলা অনুযায়ী উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। ভেতরে চার কোনায় চারটি ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভ। তিনটি মেহরাব। মেহরাবের পেছনে ইমানি পরশ মিশ্রিত বেশকিছু আরবি শিলাফলক। ধুলোয় মাখা ফলকের অক্ষরগুলো বলছে শত বছরের ইতিহাসের কথা। খিলান আকৃতির প্রবেশপথ।

দু’পাশে দুটি জানালা। কালো মেঝ। শাদা কার্নিশ। বিভিন্ন জায়গায় ইট কেটে মুসলিম স্থাপত্যকলার অপূর্ব নকশা। বাইরে সবুজ মাঠ। প্রাণ জুড়ানো ঘাস। বিশাল এক পুকুর। সবুজ পানি। ভাঙা পাড়। শেওলা পড়া আধাপাকা ঘাট। পাশে শতবর্ষী কিছু গাছ। গাছের শীতল ছায়া। সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত মুসলিম বীর ‘শহিদ বাবা আদম’।

বলছি মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার দরগাবাড়ী গ্রামে অবস্থিত বাবা আদম মসজিদের কথা। খ্রিষ্টাব্দ চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ’র শাসনামলে তার আগ্রহে মসজিদটি নির্মিত হয়।

বাবা আদমের মৃত্যুর প্রায় ৪০০ বছর পর সমাধীর পাশে স্মৃতিকথার ইট সাজিয়ে স্থাপনাটি গড়ে তোলেন বিক্রমপুরের তৎকালীন মহান শাসক মালিক কাফুরশাহ।

প্রিয় নবী (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফের সন্তান বাবা আদম। জন্ম খ্রিষ্ট ১০৯৯ সালে। শিক্ষার হাতেখড়ি নবীর শহর মক্কায়। হিজরত করে আসেন বাগদাদে। দ্বীনের আলো দিকদিগন্তে ছড়িয়ে দিতে একদিন বাগদাদ ছাড়েন। পথের বাঁকে একাদশ শতাব্দীতে চলে আসেন বাংলায়।

বাংলার সবুজ-শ্যামল পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করে। আপ্লুত করে এখানের মানুষের সরলতা। থেকে যান এখানেই। বসত গড়েন বাংলার সমৃদ্ধ অঞ্চল বিক্রমপুরে। তৎকালীন সময়ে বিক্রমপুরের শাসক ছিলেন হিন্দু রাজা বল্লাল সেন। তিনি অত্যাচারী বল্লালের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েন।

বাবা আদম স্থানীয় অত্যাচারী হিন্দু রাজার সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হোন। তার স্মৃতি ধরে রাখতে নির্মিত হয় কালজয়ী এ মসজিদ। মসজিদের আবির রং দর্শনার্থীদের স্মরণ করিয়ে দেয় শহিদ বাবা আদমের রক্তদানের কথা।

অনন্য এ মুসলিম স্থাপনাটি ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ‘প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর’ তত্ত্বাবধান করছে। তবুও এর অবস্থা গুরুতর। দেয়াল খসে পড়েছে। জরাজীর্ণ ফ্লোর। ছাদে গজিয়েছে দূর্বা ঘাস। প্রায় ভেঙে গেছে প্রবেশদ্বার। মনে হয়, বহু দিনের পুরনো এ স্থাপনা যেন বেঁেচ থাকার ফরিয়াদ করছে প্রতিনিয়ত।

কালের আবর্তে কর্তৃপক্ষের অযত্নে-অবহেলায় হারিয়ে যাবে না তো বাবা আদমের এ স্মৃতি স্থাপনাটি?

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক
যুগান্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.