চার উপজেলার ভরসার সেতুর কাজে ঢিমেতাল

২০২০ সালে সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে কাজের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। তা-ও শেষ হয়নি সেতু। রাজধানীর সঙ্গে মুন্সিগঞ্জের চার উপজেলার যোগাযোগ সহজ করতে সিরাজদিখান উপজেলা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর শাখা নদীর ওপর চলছে একটি সেতুর নির্মাণকাজ। চারটি উপজেলার আশার এ সেতুর নির্মাণকাজ দুই বছর আগে শেষ হওয়ার কথা ছিল। সময় বাড়িয়েও তা সম্ভব হয়নি। কবে কাজ শেষ হবে, তা বলতে পারছেন না কেউই।

কেরানীগঞ্জ এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, ৩৩ কোটি ২৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ৬ জুলাই সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। আটটি খুঁটির ওপরে সাতটি স্প্যান বসিয়ে নির্মাণ করা হবে ২৫২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার প্রস্থের সেতুটি। সুরমা এন্টারপ্রাইজ নামে রাজধানীর এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে কাজের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। তা-ও শেষ হয়নি কাজ। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৬০ শতাংশ।

কেরানীগঞ্জ এলজিইডি প্রকৌশলী মাহমুদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালীন কাজের গতি কম ছিল। ঠিকাদারদের মধ্যেও গাফিলতি ছিল। সেই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ হয়নি। এসব কারণে সেতুর কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। সময় বাড়ানোর পর চলতি মাসে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কাজের গতি দেখে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, এ বছর কাজ শেষ হবে না। কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কয়েকবার মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। লিখিতভাবেও তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এরপরও তারা কাজের গতি বাড়ায়নি।

■ সেতুটির দৈর্ঘ্য ২৫২ মিটার ও প্রস্থ ১০ মিটার।
■ সেতুটি হলে মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে ঢাকার পোস্তগোলা পর্যন্ত দূরত্ব দাঁড়াবে প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
■ তবে কাজ কবে শেষ হবে, তা বলতে পারছেন না কেউই।

এ বিষয়ে জানতে সুরমা এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার আইয়ুব আলীর মুঠোফোনে কল করা হলে সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মাসুম আলী বলেন, ‘চারবার কাজের নকশার পরিবর্তন করেছেন প্রকৌশলীরা। করোনার সময়ও তাঁরা কাজ বন্ধ রেখেছিলেন। এসব কারণেই সেতুর কাজ পিছিয়ে গেছে। আমাদের কোনো গাফিলতি নেই। আমাদের গাফিলতি থাকলে আমাদের কাছ থেকে কাজ ছিনিয়ে নেওয়া হতো। প্রকৌশলীদের গাফিলতির কারণেই কাজ হচ্ছে না।’

সেতু এলাকা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মোল্লার হাট এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর পূর্বপাশে নির্মাণাধীন সেতুর তিনটি পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। পিলারের ওপর দুটি স্প্যানের ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর পশ্চিম পাড়ে আরও তিনটি পিলার দাঁড়িয়ে আছে। তবে নদীর মধ্যখানে পিলার দুটি এখনো নির্মাণ হয়নি। নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এসব পাহারায় রয়েছেন কয়েক ব্যক্তি।

নির্মাণাধীন সেতুর ঠিক দক্ষিণ পাশ দিয়ে ছোট একটি ফেরিতে মুন্সিগঞ্জ সদর, সিরাজদিখান ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মানুষেরা ঢাকায় যাতায়াত করছেন। এ পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী লোকজন জানালেন, মোল্লারহাট সেতুটি হয়ে গেলে মুন্সিগঞ্জ সদর, টঙ্গিবাড়ী, লৌহজং ও সিরাজদিখান উপজেলার প্রায় ১৫ লাখ মানুষের ঢাকাসহ আশাপাশের জেলাগুলোতে যাতায়াতে সময়, অর্থ, ভোগান্তি কমে যাবে।

সেতুটি হলে মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে টঙ্গিবাড়ির বেতকা চৌরাস্তা, সিরাজদিখান ও মোল্লারহাট হয়ে ঢাকার পোস্তগোলা পর্যন্ত দূরত্ব দাঁড়াবে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। তখন সদর এলাকা থেকে এ সড়ক পাড়ি দিতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা।

বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ সদরের অধিকাংশ মানুষ মুক্তারপুর সেতু হয়ে ঢাকায় যোগাযোগ করেন। সড়কটি সরু এবং সব সময় তীব্র যানজট লেগে থাকে। ফলে এ পথে ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লেগে যায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা।

এ কারণে অনেকে ঘুরে সিরাজদিখান হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে অথবা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মোল্লার হাট দিয়ে ফেরি পার হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করেন। এ ক্ষেত্রে সময় লাগে অন্তত দুই ঘণ্টা। একই রকম ভোগান্তি টঙ্গিবাড়ি, সিরাজদিখান ও লৌহজংয়ের বাসিন্দাদেরও।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার সিপাহীপাড়া এলাকার বাসিন্দা আলী আকবর এ পথ দিয়ে নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, মুক্তারপুর হয়ে ঢাকায় যেতে কম করে আড়াই-তিন ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে মোল্লার হাট ঘাট হয়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় যেতে লাগে
৪০-৫০ মিনিট। সেতু হলে এ সময় আরও কমে যাবে। সড়কপথে সরাসরি মানুষ ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে।

সিরাজদিখান উপজেলার চরপানিয়া এলাকার বাসিন্দা আয়েশা খাতুন (৭০)। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় খেয়াঘাট এলাকায়। তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে যখন এই নদীর ওপর সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়, তখন সহজ যোগাযোগের আশায় মনটা আনন্দে ভরে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম মৃত্যুর আগে অন্তত এই সেতু দিয়ে সড়কপথে ঢাকায় যাতায়াত করব। সেতুর কাজ দেখে সে আশা ছেড়ে দিয়েছি।’

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নদীর দুই পারে দেশের শীর্ষস্থানীয় একাধিক হাউজিং প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প রয়েছে। তাঁরা কম দামে জমি ক্রয়ের জন্য সেতু নির্মাণে ষড়যন্ত্র করছে। এ ছাড়া প্রতিদিন অর্ধলাখ মানুষ ও পণ্যসামগ্রী নৌযান দিয়ে নদী পারাপার হয়। সেখানেও টাকার ছড়াছড়ি। এ জন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারেরা স্থানীয় প্রভাবশালী ও জমি ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে সেতুর কাজ কখনো বন্ধ, কখনো ধীরগতিতে করছেন।

প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.