ব.ম শামীম: দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) মুন্সিগঞ্জ সার্কেল অফিস। বছরের পর বছর ঘুরেও লাইসেন্স নবায়ন করতে পারছেন না সেবাগ্রহীতারা। এছাড়া ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এসে ভোগান্তি, লাইসেন্স নবায়নে টাকা বেশি নেওয়াসহ উঠেছে নানা অনিয়মের চিত্র।
অভিযোগ আছে, যথাসময়ে অফিসে আসেন না এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
রোববার সকাল ৯টায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অফিসের প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। সেখানে পাঁচ-ছয়জন সেবাগ্রহীতা অপেক্ষা করছেন। সকাল ৯.৩৭ মিনিটে এক স্টাফ অফিসের ফটক খুলে দেন। সকাল ১০টার পর এক এক করে আসতে থাকেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গতকাল রোববার সকাল ৯টায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অফিসের প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। সেখানে পাঁচ-ছয়জন সেবাগ্রহীতা অপেক্ষা করছেন। সকাল ৯.৩৭ মিনিটে এক স্টাফ অফিসের ফটক খুলে দেন। সকাল ১০টার পর এক এক করে আসতে থাকেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এখানে এলে আমার অস্থায়ী অনুমতিপত্রে ছয় মাসের ডেট দিয়ে একটি সিল মেরে সই করে দেয়। বলা হয়, এখনও লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। এ নিয়ে পাঁচবার এলাম। এখানে এলে সেদিন আর গাড়ি চালানো হয় না। সারাদিনে এক হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। তারা দিনের পর দিন সময়ক্ষেপণ করছে, কিন্তু লাইসেন্স নবায়ন করে দিচ্ছে না
ভুক্তভোগী গোবিন্দ বিশ্বাস
সকাল ৯টার দিকে মুন্সিগঞ্জ বিআরটিএ অফিসে আসেন ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার খান্দাইল এলাকার গোবিন্দ বিশ্বাস (৬০)। অফিসের সামনে রাখা বেঞ্চে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন। পরে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাই। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন লাইসেন্স পাইনি।
‘এখানে এলে আমার অস্থায়ী অনুমতিপত্রে ছয় মাসের ডেট দিয়ে একটি সিল মেরে সই করে দেয়। বলা হয়, এখনও লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। এ নিয়ে পাঁচবার এলাম। এখানে এলে সেদিন আর গাড়ি চালানো হয় না। সারাদিনে এক হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। তারা দিনের পর দিন সময়ক্ষেপণ করছে, কিন্তু লাইসেন্স নবায়ন করে দিচ্ছে না।’
সকাল ৯টা থেকে অফিসের সামনের বেঞ্চে বসে অপেক্ষায় ছিলেন মুন্সিগঞ্জ শ্রীনগর উপজেলার কামারগাঁও এলাকার মো. ইউনুসও (৫০)। বলেন, ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের জন্য দিয়েছিলাম। এখনও হাতে পাচ্ছি না। আমি প্রাইভেটকার চালাই। লাইসেন্স নিতে বিআরটিএ অফিসে পাঁচবার এলাম। এখানে এলে প্রতিবার সাত/আটশো টাকা খরচ হয়। পুরো দিনে আর কাজ করা হয় না।
আমি লাইসেন্স নবায়ন করতে দিয়েছি। নবায়ন ফি দুই হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু আমার কাছ থেকে চার হাজার টাকা নিয়েছে। অফিসের ভেতরেই লোক আছে, তাদের কাছে টাকা দিয়েছি। তারাই লাইসেন্স করে দেবে। মুন্সিগঞ্জ অফিসে একটি সুবিধা হলো এখানে বাইরের কোনো দালাল নেই। অফিসের লোকজনই দালাল। তাদের কাছে টাকা দিলে কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকা যায়
লাইসেন্স নবায়ন করতে আসা নুরুল ইসলাম
‘এখানে এলেই দায়িত্বরতরা আমার অস্থায়ী অনুমতিপত্রে ছয় মাসের মেয়াদ বাড়িয়ে একটি সিল মেরে সই করে দেন। এবার বলছে তিন মাসের মেয়াদ বাড়িয়ে সিল মেরে দেবে।’
ঢাকার উত্তরা এলাকার মিলন (৪০) বলেন, ২০২০ সালের মে মাসে লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করি। এখনও তা আমাকে দেওয়া হয়নি। এখানে এলেই একটি সিল মেরে সই করে মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু লাইসেন্স দেয় না।
সকাল ৯.১৫ মিনিটে নতুন লাইসেন্স পেতে পরীক্ষা দিতে আসেন মুন্সিগঞ্জ মুক্তাপুর এলাকার সোহাগ (২৮) ও আরিফ (৩০)। এই প্রতিবেদককে তারা বলেন, আজ লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। এসে দেখছি অফিস বন্ধ। চলে যাচ্ছি, পরে আবার আসব।
দুপুর সাড়ে ১২টায় লাইসেন্সের জন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে আসেন সদর উপজেলার মাঠপাড়া এলাকার সাব্বির (৩২)। ফিঙ্গার প্রিন্ট না দিতে পেরে অফিসের বাইরে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা যায় তাকে। এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি ঢাকায় থাকি। ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এখানে এসেছি। আসার পর দায়িত্বরতরা বলছেন আজ ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া যাবে না। কারণ যিনি ফিঙ্গার প্রিন্ট নেন তিনি ছুটিতে রয়েছেন।
ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে এসে সাইদ (৩০) নামের আরেকজনকেও ফিরে যেতে দেখা যায়। দুপুর ১.১৫ মিনিটের দিকে বিআরটিএ অফিসে আসেন মুন্সিগঞ্জ সদরের মাকহাটি এলাকার আলী আজগর (৩২)। তার মোটরসাইকেলের লাইসেন্সের মেয়াদ কবে শেষ হবে তা জানার জন্য এসেছেন তিনি। এ সময় অফিস কর্তৃপক্ষ তাকে অপারেটর নেই বলে ফিরিয়ে দেয়। অফিস কর্তৃপক্ষ এক সপ্তাহ পর যোগাযোগ করতে বলেছেন বলে জানান তিনি।
অফিসের বাইরের চেয়ারে দুপুর দেড়টার দিকে অপেক্ষা করছিলেন ইয়ামাহা কোম্পানির মুন্সিগঞ্জ ডিলার অফিসের ম্যানেজার আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে এসেছি এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। কাগজপত্র জমা নিয়ে অফিসের লোক বলল, ‘একটু বসেন আসছি’। এরপর এক ঘণ্টা ধরে বসে আছি। ওই লোক এখনও ফেরত আসছেন না।
কাউকে এ অফিসে লাইসেন্সের জন্য ঘুরতে হয় না। তবে, লাইসেন্স নবায়নের জন্য ডোপ টেস্ট ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হয়। এগুলো করতে চাইলে অনেকে না দিয়ে চলে যান। ফলে তাদের ঘুরতে হয়
মো. তৌহিদুল ইসলাম তুষার, সহকারী পরিচালক, মুন্সিগঞ্জ বিআরটিএ
ঢাকার উত্তরার নুরুল ইসলাম (৬৫) বলেন, আমি লাইসেন্স নবায়ন করতে দিয়েছি। নবায়ন ফি দুই হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু আমার কাছ থেকে চার হাজার টাকা নিয়েছে। অফিসের ভেতরেই লোক আছে, তাদের কাছে টাকা দিয়েছি। তারাই লাইসেন্স করে দেবে। মুন্সিগঞ্জ অফিসে একটি সুবিধা হলো এখানে বাইরের কোনো দালাল নেই। অফিসের লোকজনই দালাল। তাদের কাছে টাকা দিলে কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকা যায়।
নারায়ণগঞ্জ জালকুড়ি এলাকার মিন্টু বলেন, তিন মাস আগে লাইসেন্স নবায়নের জন্য পরীক্ষা দিয়েছি। এখনও স্লিপ পাচ্ছি না। লাইসেন্স নবায়নের জন্য নারায়ণগঞ্জের এক দালালের কাছে সাত হাজার টাকা দিই। সে আমাকে মুন্সিগঞ্জের প্রাণ ভাই নামের এক ব্যক্তি কাছে পাঠায়। এরপর তার মাধ্যমে পরীক্ষা দিই। কিন্তু আমাকে স্লিপ দেওয়া হচ্ছে না।
‘আমি ট্রাক চালাই। পাঁচ বছর পরপর আমাদের লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। প্রতিবার নতুন করে পরীক্ষা দিতে হয়। এবার পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স তো দূরের কথা, স্লিপও পাচ্ছি না। এখানে এসে ওই দালালেরও দেখা পাচ্ছি না।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ বিআরটিএ অফিসের সহকারী পরিচালক মো. তৌহিদুল ইসলাম তুষার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাউকে এ অফিসে লাইসেন্সের জন্য ঘুরতে হয় না। তবে, লাইসেন্স নবায়নের জন্য ডোপ টেস্ট ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হয়। এগুলো করতে চাইলে অনেকে না দিয়ে চলে যান। ফলে তাদের ঘুরতে হয়।
‘লাইসেন্স নবায়নের জন্য অপেশাদারদের চার হাজার ১৫২ টাকা এবং পেশাদারদের দুই হাজার ৪৭৫ টাকা দিতে হয়। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো টাকা নেওয়া হয় না।’
আমি আসার আগে রাজা মোল্লা নামের এক ব্যক্তি এখানে দালালি করত। তাকে এখান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এখন কোনো দালাল নেই
মো. তৌহিদুল ইসলাম তুষার, সহকারী পরিচালক, মুন্সিগঞ্জ বিআরটিএ
অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এমন কোনো অভিযোগ আমি পাইনি। পেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব। এ জেলায় গত আড়াই বছরে এক হাজার ২০টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে আট থেকে ১০ হাজার লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে।
তবে, পুরো জেলায় এখন পর্যন্ত কতগুলো লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব আমাদের কাছে নেই— বলেন ওই কর্মকর্তা। প্রতি মাসে এখানে ২০০ লাইসেন্সপ্রত্যাশীর পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ৫০/৬০ জন পরীক্ষা দিতে আসেন। এর মধ্যে ১৬ থেকে ২০ জন পাস করেন।
অফিসের অনেকে অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত— এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তৌহিদুল ইসলাম তুষার বলেন, ‘আমি আসার আগে রাজা মোল্লা নামের এক ব্যক্তি এখানে দালালি করত। তাকে এখান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এখন কোনো দালাল নেই।’
ব.ম শামীম/কেএ
Leave a Reply