মালিকের সামনেই লুট হচ্ছে ফসলি জমির মাটি

ফয়সাল হোসেন: চর আবদুল্লাহ মৌজার খাড়াচর ও বাহেরচর এলাকায় ফসলি জমিতে মাটি কাটা চলছে। এক কিলোমিটারজুড়ে এ দৃশ্য চোখে পড়ে।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চরাঞ্চলে জবরদস্তি করে কৃষকের সামনেই কেটে নেওয়া হচ্ছে ফসলি জমির মাটি। এসব মাটি ইটভাটায় বিক্রি করছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের চর আবদুল্লাহ মৌজার জমি থেকে দিনরাত সমানতালে কাটা হচ্ছে মাটি।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, দেদার কাটা হচ্ছে উপজেলার চর আবদুল্লাহ মৌজার খাড়াচর ও বাহেরচর এলাকায় ফসলি জমির মাটি। ওই দুই এলাকার অন্তত এক কিলোমিটারজুড়ে মাটি কাটার দৃশ্য চোখে পড়ে। মাটি কেটে নেওয়ায় জমির বিভিন্ন স্থানে চার থেকে পাঁচ ফুট গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। চারটি বড় বড় এক্সকাভেটর (খননযন্ত্র) দিয়ে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে ড্রাম্প ট্রাকে ভরা হচ্ছে। সেসব মাটি নিয়ে ৫০ মিটার দূরে নদীর পাড়ে স্তূপ করা হচ্ছে। সেখান থেকে আবার দুটি এক্সকাভেটর দিয়ে নৌযানে তোলা হচ্ছে মাটি। এ কাজে জড়িত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব মাটির শেষ গন্তব্য ইটভাটা।

মাটি কাটার ছবি তুলতে গেলে ইয়াসিন আরাফাত নামের এক ব্যক্তি বাধা দেন। তিনি বলেন, এলাকায় ছবি তোলা, ভিডিও করা নিষেধ। এসব করলে ঝামেলা হবে। এর মধ্যে সংবাদকর্মীদের দেখে এলাকার ৮–১০ জন কৃষক জড়ো হন। প্রকাশ করেন নিজেদের অসহায়ত্ব। তাঁরা বলেন, ইউনিয়নের কালীরচর এলাকার গোলাম কিবরিয়া ওরফে মিয়াজী নামের এক ব্যক্তি জোর করে মাটি কেটে বিক্রি করে দিচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কৃষক বলেন, ‘যে জমিতে ফসল ফলিয়ে চরাঞ্চলের শত শত দরিদ্র কৃষকের সংসার চলত। সে জমি কিবরিয়া মিয়াজী তাঁর দলবল দিয়ে এক মাসের বেশি সময় ধরে কেটে ফেলছেন। প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধশত নৌযানের মাধ্যমে ইটভাটায় পাঠানো হচ্ছে মাটি। আমাদের চোখের সামনেই আমাদের জমি কাটছে। হাতে-পায়ে ধরেও তাঁদের আটকানো যাচ্ছে না। ভয়ে প্রতিবাদও করতে পারছি না।’

ওই এলাকায় সাড়ে চার একর জমির মালিক কৃষক আমজাদ ব্যাপারী। জমিতে ফসল ফলানোই তাঁর একমাত্র আয়ের পথ। চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাটি কেটে নেওয়ায় চলতি মৌসুমে ফসল আবাদ করতে পারছেন না তিনি। হতাশা প্রকাশ করে আমজাদ ব্যাপারী বলেন, ‘আমাদের না জানিয়ে জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মাতবরদের নিয়ে বাধা দিতে এসেছিলাম। তাঁরা টাকা খেয়ে চুপ করে চলে গেছেন। আর কিবরিয়ার কাছে গেলে বলেন, তিনি আমাদের জমি তিন বছরের জন্য কিনে নিয়েছেন। আমাদের জমি কার কাছ থেকে, কীভাবে কিনে নিলেন তিনি? প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি—সবাই টাকার কাছে জিম্মি হয়ে গেছে।’

অভিযোগের বিষয়ে গোলাম কিবরিয়া মিয়াজী বলেন, কারও জমি থেকে জোর করে মাটি কাটা হচ্ছে না। যেসব জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে, সেখানে নিজেদের জমি রয়েছে। এ ছাড়া অনেকের কাছ থেকে মাছ চাষের জন্য জমি লিজ নিয়েছেন। মাছের ঘের করার জন্য সেসব জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছেন। জমিগুলোর কাগজপত্র নিজের কাছে আছে বলে দাবি করেন কিবরিয়া মিয়াজী। কাগজপত্র দেখতে চাইলে পরে দেখানোর কথা বলে এক সপ্তাহ পার করেন তিনি। তবে কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি।

আমাদের না জানিয়ে জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মাতবরদের নিয়ে বাধা দিতে এসেছিলাম। তাঁরা টাকা খেয়ে চুপ করে চলে গেছেন।
আমজাদ ব্যাপারী, ভুক্তভোগী কৃষক

আবাদি জমির মাটি কাটা বন্ধ করা ও জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর এক সপ্তাহ আগে কৃষকদের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেন বাংলাবাজার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মরতুজা সরকার। তিনি নিজেও ভুক্তভোগী। গোলাম মরতুজা বলেন, ‘ওই এলাকায় আমার প্রায় ৫০ একর জমি ছিল। সেখানে আলু, ধান ও শর্ষে চাষ করা হতো। কিন্তু কয়েক মাস ধরে ভূমিদস্যু কিবরিয়া প্রভাব খাটিয়ে আবাদি জমির মাটি কেটে নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে আমার প্রায় ২০ একর জমির মাটি ৭-৮ ফুট গর্ত করে নিয়ে গেছেন। আমি বাধা দেওয়ায় চুপ থাকার জন্য তাঁরা আমাকে ২০ লাখ টাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। স্মারকলিপি দেওয়ার পর প্রশাসন “আজ দেখছি, কাল দেখছি” বলে কালক্ষেপণ করছে।’

কৃষিবিদদের মতে, ফসলি জমির উপরিভাগের ১০ থেকে ১২ ইঞ্চির মধ্যে মাটির জৈব উপাদান থাকে। সেই মাটি কাটা হলে জমির জৈব উপাদান চলে যায়। এতে জমির স্থায়ী ক্ষতি হয়। ফসলি জমির মাটি কাটা তাই বেআইনি।

মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল প্রথম আলোকে বলেন, কোনোভাবেই ফসলি জমির মাটি কাটা যাবে না। যে বা যাঁরা কৃষকের ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছেন, তাঁদের খোঁজ নেওয়া হবে। তাঁরা যত শক্তিশালী হোক, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.