ফয়সাল হোসেন: ভোর হতেই বিষমুক্ত শাকসবজি নিয়ে আসতে থাকেন কৃষকরা। সে সবজি কেনার জন্য আসেন ক্রোতারাও। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক-ভোক্তাদের বেচাকেনায় জমজমাট হয়ে উঠে এ সবজির বাজার। শহরের মধ্যে একমাত্র এ বাজারেই কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কম দামে টাটকা সবজি কিনতে পারেন ক্রেতারা। সকাল ছয়টা থেকে আটটা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা চলে কেনাবেচা। মুন্সিগঞ্জ শহর বাজারের পশ্চিম পাশে কাচারি-সুপার মার্কেট সড়কে এ বাজারের অবস্থান। এটি সকালের বাজার বলে পরিচিতি পেয়েছে স্থানীয়দের কাছে।
এ বাজারের ইজারাদার ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫ থেকে ১৬ বছর আগে দু-চারজন কৃষক তাঁদের উৎপাদিত শাকসবজি নিয়ে আসতেন এ বাজারে। তখন ক্রেতা ও বিক্রেতা ছিল খুব কম। তবে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে পরিধি। বাড়তে থাকে ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা। এখন প্রতিদিন ভোরে এ বাজারে শাকসবজি কিনতে আসেন দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ। এ বাজার থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরাও সবজি কিনে মুন্সিগঞ্জের শহর বাজার, গ্রামের বাজার ও পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করেন।
সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া, যোগিনীঘাট, রমজান বেগ, চরমসুরা, কেওয়ার, সাতানিখিল, কাটাখালী, পাঁচঘরিয়াকান্দি, শিলমন্দি, রামপাল, ধলাগাঁও, বজ্রযোগিনী, মাকাহাটি, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার চর কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক শ কৃষক প্রতিদিন দুই ঘণ্টার বাজারে শাকসবজি নিয়ে আসেন। শাকসবজির মধ্যে আছে লালশাক, পুঁইশাক, বেগুন, ঢেঁড়স, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, পটোল, শিম, বরবটি, উচ্ছে, গাজর, ক্ষীরা, শসা, টমেটো, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, থানকুনি পাতাসহ অনেক কিছু।
গতকাল শুক্রবার ভোরে এ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন শাকসবজির পসরা সাজিয়ে বসেছেন কৃষকেরা। পুরো সড়ক ক্রেতাভর্তি। ক্রেতা–বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম বাজার। ক্রেতারা কেউ বাড়ির জন্য, কেউ রেস্তোরাঁর জন্য টাটকা শাকসবজি কিনছেন। কেউবা পাইকারি কিনে নিচ্ছেন খুচরা দোকানে বিক্রির জন্য।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারটি জমে ওঠায় স্থানীয় কৃষক-ভোক্তা দুই পক্ষই লাভবান হয়েছে। কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে সবজি কিনে পাইকারেরা খুচরা পর্যায়ে ১০-১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি করতেন। সে সবজিই কৃষকেরা এ বাজারে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পাইকারদের তুলনায় পাঁচ থেকে সাত টাকা বেশি দামে বিক্রি করতে পারছেন। ক্রেতারাও বাজারমূল্যের চেয়ে সাত থেকে আট টাকা কম দামে কিনতে পারছেন।
ক্রেতা–বিক্রেতাদের দাবি, বাজারটিতে সব সময় বিষমুক্ত টাটকা শাকসবজি পাওয়া যায়। শুক্রবার সকালে এ বাজারে শাকসবজি কিনতে আসেন নুর উদ্দিন ভূঁইয়া। তাঁর বাড়ি পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে। তিনি বেড়াতে এসেছিলেন মুন্সিগঞ্জ শহরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। নুর উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘শুনলাম এ বাজারটি কম দাম ও টাটকা সবজির জন্য নামকরা। আজ মদনপুর চলে যাব। তাই সকালে বাজারে এসেছিলাম সবজি কিনতে। এসে দেখলাম সব সবজির দাম অন্য বাজারের তুলনায় ৫-১০ টাকা কম। টমেটো বড় সাইজ ১২ টাকা, আলু ১৪ টাকা, কুমড়া ৫০-৭০ টাকা, লাউ ২০-২৫ টাকা মাত্র।’
কুয়েতপ্রবাসী আবুল হোসেন বলেন, তিনি যখনই দেশে আসেন, তখনই নিজ হাতে টাটকা সবজি কিনতে ভোরবেলা এ বাজারে আসেন। তাঁর দাবি, সচরাচর যেসব শাকপাতা অন্য কোনো বাজারে পাওয়া যায় না, সেসব শাক, ওষুধি পাতা এ বাজারে পাওয়া যায়। এ বাজারে সব ধরনের শাকসবজি কম দামে পাওয়া যায়।
এ বাজারের ফলে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন জানিয়ে সাতানিখিল এলাকার কৃষক শরীফ হোসেন বলেন, ‘পাঁচ বছর আগেও এ বাজারে খুচরা ক্রেতা খুব কম ছিল। তখন বাধ্য হয়ে কম দামে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে সবজি বিক্রি করতাম। এখন খুচরা ক্রেতা খুব বেশি। তাঁদের কাছে বিক্রি করতে ভালোও লাগে। খেতের সবজি বাজারে আনার পরপরই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যে টমেটো পাইকারিভাবে ৮ থেকে ৯ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে, সে টমেটো আমরা ক্রেতাদের কাছে ১২-১৫ টাকা কেজি ধরে বিক্রি করছি।’
জমির উৎপাদিত আলু, বেগুন, কুমড়া, লালশাক, ডাঁটা, লাউ বিক্রি করতে এ বাজারে এসেছেন রমজানবেগ এলাকার কৃষক মো. শাওন। তিনি বলেন, দেড় ঘণ্টার মধ্যে তাঁর সব শাকসবজি বিক্রি হয়ে গেছে। মোটামুটি দামও ভালো পেয়েছেন। চার বছর ধরে প্রতিদিন এ বাজারে শাকসবজি বিক্রি করেন বলে জানালেন শাওন।
এ বাজারের ইজারাদার মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা তুলনামূলক কম দামে ভালো ও টাটকা শাকসবজি চান, তাঁদের এ বাজারে আসতে হবে। মুন্সিগঞ্জের মধ্যে একমাত্র এ বাজারেই কৃষকেরা সরাসরি ক্রেতাদের কাছে সব শাকসবজি বিক্রি করে থাকেন। প্রতিদিন ছয় থেকে সাত লাখ টাকার শাকসবজি বেচাকেনা হয়। সবজি মৌসুমে বিক্রি আরও বেশি হয়।
প্রথম আলো
Leave a Reply