কলাপাতায় সুস্বাদু ক্ষীর

ইমতিয়াজ বাবুলঃ মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের বড় মিষ্টির দোকানে গেলে চোখে পড়বে কলাপাতার ওপর রাখা এক ধরনের ক্ষীর। পাতায় মুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে এর নাম পাতাক্ষীর। স্থানীয়ভাবে অবশ্য এটি পরিচিত পাতক্ষীর নামে। আপাতদৃষ্টিতে একে অন্য সাধারণ মিষ্টির একটি ধরনের মতো লাগলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় দেড়শ বছরের ঐতিহ্য। মুখরোচক এ ক্ষীর না খেলে স্থানীয় কোনো উৎসবই যেন পূর্ণতা পায় না। শুধু সিরাজদীখান নয়; দেশ ছাড়িয়ে পাতক্ষীর পৌঁছে গেছে বিদেশেও। বিশেষ উপায়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয় এ ক্ষীর।

বিখ্যাত এ মিষ্টির মূল কারিগরদের নিবাস আদি বিক্রমপুর তথা বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদীখান উপজেলার সন্তোষপাড়ায়। লিপিবদ্ধ ইতিহাস না থাকলেও লোকমুখে জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে এই মিষ্টি প্রথম তৈরি করেন স্থানীয় পুলিন বিহারি দেব দম্পতি। পুলিন বিহারি স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে পাতক্ষীর তৈরি করে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করতেন। তাঁর দেখাদেখি ওই সময় অনেকেই এ ক্ষীর তৈরি শুরু করেন। এখন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম বানাচ্ছে এটি। কালের স্রোতে মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী অনেক পণ্য হারিয়ে গেলেও পাতক্ষীর টিকে আছে সগৌরবে।

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের প্রায় দেড়শ বছরের ঐতিহ্য পাতাক্ষীর – সমকাল

সিরাজদীখানের বাসিন্দারা জানান, গরুর দুধ দিয়ে তৈরি করা এ ক্ষীর প্রথম থেকেই জনপ্রিয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি তাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। সিরাজদীখান বাজারের মিষ্টি দোকানিরা জানান, শীতে পাতক্ষীরের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। তাঁদের কারিগররা দোকানেই এ ক্ষীর বানান। তাই বাজারের রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার, মা ক্ষীর ভান্ডারসহ অধিকাংশ দোকানেই মিলবে পাতক্ষীর।

পাতক্ষীরের কারিগররা জানান, শুধু গরুর দুধ দিয়েই সুস্বাদু এ ক্ষীর তৈরি হয়। রয়েছে বিশেষ পদ্ধতি। প্রথমে তিন থেকে সাড়ে তিন লিটার দুধ কড়াইয়ে ঢেলে গনগনে আঁচে অনেকক্ষণ জ্বাল দেওয়া হয়। কাঠের চামচ দিয়ে নেড়ে সেই দুধ ঘন করা হয়। এর পর সামান্য হলুদ ও চিনি মিশিয়ে চুলা থেকে নামানো হয়। মাটির পাতিলে রেখে প্রায় ১ ঘণ্টা ঠান্ডা করার পর কলাপাতায় মুড়িয়ে বিক্রি করা হয় মুখরোচক পাতক্ষীর।

তাঁরা আরও জানান, রন্ধন প্রণালি সাধারণ হলেও সঠিক কৌশল জানা না থাকলে ভালো পাতক্ষীর তৈরি করা যায় না। প্রতিটি পাতক্ষীরের ওজন হয় প্রায় আধা কেজি। দোকানভেদে দাম পড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বিশেষ উৎসব ছাড়াও সারাবছর এর চাহিদা থাকে। বাড়িতে এসেও অনেকে অর্ডার দিয়ে যান।

সিরাজদীখান বাজারের মা মিষ্টান্ন ভান্ডারের ডিকি ঘোষ জানালেন, তাঁর দাদু প্রায় ৫০ বছর পাতক্ষীরের ব্যবসা করেছেন। এর পর তাঁর বাবা করেছেন। এখন তাঁরা করছেন। ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয় এই পাতক্ষীর।

স্থানীয়রা জানান, ঐতিহ্যবাহী ও সুস্বাদু হলেও পাতক্ষীরের প্রচার তুলনামূলক কম। সরকার থেকে সহায়তা এবং যথাসাধ্য প্রচার চালালে পাতক্ষীর ব্যবসায়ীরা অনেক লাভবান হতে পারতেন। দেশের মানুষও অনন্যসাধারণ এ মিষ্টির স্বাদ নিতে পারতেন।

সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.