মুন্সীগঞ্জে আধা-পাকা ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ, দিশেহারা কৃষক

আড়িয়ল বিলে বোরো ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন নিয়ে শঙ্কায় চাষিরা। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে চলছে আগাম ধান কাটার প্রস্তুতি। তবে মৌসুমের শেষ সময় আধা-পাকা ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক।

কৃষি বিভাগ বলছে, ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে ধানের শীষের গোড়া ও গিঁট কালো হয়ে যাচ্ছে। এতে ধানের ছড়া গিঁট ভেঙে পড়ার পাশাপাশি রোগটি পুরো জমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। এতে কাঙ্ক্ষিত ফলন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ‘শস্য ভাণ্ডার’ খ্যাত আড়িয়ল বিলসহ উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের বিভিন্ন চকব্যাপী এখন শুধুই সোনালী ফসলের সমারোহ। বোরো মৌসুমে এ উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে বিভিন্ন জাতের ধান চাষ হয়েছে।

এর মধ্যে বির্স্তীণ আড়িয়ল বিলের শ্রীনগর অংশেই প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম ধান চাষ করেছেন কৃষক। ধান প্রায় পরিপক্ব হয়েছে। ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখছে কৃষক। ধারণা করা হচ্ছে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহেই পুরোদমে ধান কাটা উৎসব শুরু হবে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আড়িয়ল বিলের বাড়ৈখালী, ষোলঘর, গাদিঘাট, আলমপুর, শ্রীধরপুর, মদনখালীতে বেশির ভাগ জমিতে ধান পেকে গেছে। ধান কাটতে কৃষি শ্রমিক ঠিক করা হচ্ছে।

ধান কাটা ও মাড়াই কাজের জন্য গৃহস্থরা আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রস্তুত করছেন। বড় গৃহস্থরা ধান মাড়াইয়ের জন্য নতুন মেশিন কিনেছেন।

বিল পাড়ের কৃষকরা জানান, ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় দ্রুত ধান কাটার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বিঘা প্রতি জমিতে ২৮-৩০ মণ ধান উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন তারা।

উপজেলার গোল্ডেন সিটি, পাটাভোগ, খৈয়াগাঁও, বীরতারাসহ বিভিন্ন চকে বিস্তীর্ণ জমিতে ব্লাস্ট রোগে দেখা দিয়েছে। এতে জমিতে অপরিপক্ব ধানের ছড়া গিঁট থেকে ভেঙে যাচ্ছে।

হরপাড়া এলাকার কৃষক আব্দুল আউয়াল বলেন, “১৫ গণ্ডা জমিতে (১০৫ শতাংশ) ধান চাষ করেছি। ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

দক্ষিণ পাটাভোগের শেখ দেলোয়ার, শেখ মালেক, মো. কামরুল জানান, পাটভোগ চকের ধান এখনও আধা কাঁচা। এ চকের বেশিরভাগ জমিতেই ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। এতে করে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসবে।

উপজেলা কৃষি অফিসার মোহসিনা জাহান তোরণ বলেন, “সারা দেশেই ব্লাস্ট রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২৮ জাতের ধানের জমিতে এ রোগটির আক্রমণ বেশি। রোগটি দমনে জমিতে ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের।”

এ উপজেলায় ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪২ হাজার ৫৬০ টন। এতে প্রদর্শনী ক্ষেত রয়েছে ৫০টি। তবে সরকারিভাবে এখনও ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়নি বলে এ কৃষি কর্মকর্তা জানান।

সরকারের ‘কৃষি তথ্য সার্ভিস’র ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ব্লাস্ট রোগ ধান গাছের তিনটি অংশে আক্রমণ করে থাকে। গাছের আক্রান্ত অংশের ওপর ভিত্তি করে এ রোগ তিনটি নামে পরিচিত: ১. পাতা ব্লাস্ট, ২. গিট ব্লাস্ট এবং ৩. শীষ ব্লাস্ট।

পাইরিকুলারিয়াগ্রিসিয়া নামের ছত্রাকের আক্রমণ থেকে এই রোগ হয়ে থাকে। রোগটি আমন ও বোরো উভয় মৌসুমেই হতে পারে। ধানের চারা অবস্থা থেকে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় রোগটি হতে পারে। বীজ, বাতাস, কীটপতঙ্গ ও আবহাওয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। রাতে ঠাণ্ডা, দিনে গরম ও সকালে পাতলা শিশির জমা হলে এ রোগ দ্রুত ছড়ায়।

হালকা মাটি বা বেলেমাটি যার পানি ধারণক্ষমতা কম সেখানে রোগ বেশি হতে দেখা যায়। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম পটাশ সার দিলে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। দীর্ঘদিন জমি শুকনো অবস্থায় থাকলেও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে।

পাতা ব্লাস্ট

পাতায় প্রথমে ডিম্বাকৃতির ছোট ছোট ধূসর বা সাদা বর্ণের দাগ দেখা যায়। দাগগুলোর চারদিক গাঢ় বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এ দাগ ধীরে ধীরে বড় হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ করে। অনেক দাগ একত্রে মিশে পুরো পাতাটাই মেরে ফেলতে পারে। এ রোগে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে জমিতে মাঝে মাঝে পুড়ে যাওয়ার মতো মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রে খোল ও পাতার সংযোগস্থলে কালো দাগের সৃষ্টি হয়; যা পরবর্তীতে পচে যায় এবং পাতা ভেঙে পড়ে ফলন বিনষ্ট হয়।

গিঁট ব্লাস্ট

ধান গাছের থোড় বের হওয়ার পর থেকে এ রোগ দেখা যায়। গিঁটে কালো রঙের দাগ সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে এ দাগ বেড়ে গিঁট পচে যায়, ফলে ধান গাছ গিঁট বরাবর ভেঙে পড়ে।

শীষ ব্লাস্ট

এ রোগ হলে শীষের গোড়া অথবা শীষের শাখা প্রশাখার গোড়ায় কাল দাগ হয়ে পচে যায়। শীষ অথবা শীষের শাখা প্রশাখা ভেঙে পড়ে। ধান চিটা হয়।

এ রোগের প্রতিকারে রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হয়। মাটিতে জৈব সারসহ সুষম মাত্রায় সব ধরনের সার ব্যবহার করতে হয়। আক্রান্ত জমির খড়কুটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং ছাই জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সুস্থ গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে, দাগি বা অপুষ্ট বীজ বেছে ফেলে দিয়ে সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে।

রোগের আক্রমণ হলে জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। জমিতে সব সময় পানি রাখতে হবে।

এ ছাড়া কৃষি বিভাগের পরামর্শে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।

বিডিনিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.