মুন্সীগঞ্জ-২: আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে একাধিক প্রার্থী

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল: পদ্মা তীরের লৌহজং এবং টঙ্গীবাড়ি উপজেলা নিয়ে গঠিত মুন্সীগঞ্জ-২ আসন নানা কারণেই আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতুর উত্তর প্রান্ত মাওয়াকে বলা হয় দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। আর ‘মাওয়া’ এই অঞ্চলে শুধু নয় দেশেরও পরিচিত নাম। এখান দিয়ে প্রতিদিন দক্ষিণবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ যাতায়াত করে থাকেন। এমনকি দশ মাস আগেও লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ঘাটটি ছিল দেশের ব্যস্ততম স্থানগুলোর একটি। শিমুলিয়া থেকে কাঁঠালবাড়ী ও মাঝিরকান্দি নৌপথে ফেরিসহ লঞ্চ ও স্পিডবোট দিয়ে মানুষজন চলাচল করেছে।

গত বছর ২৬ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় শিমুলিয়া ঘাট পারাপারে ঝামেলা নেই। এখন রূপান্তর হয়েছে পর্যটন কেন্দ্রে। শিমুলিয়া ঘাটের অদূরে এখন দেশের সর্ববৃহৎ রেস্তোরাঁ ‘প্রজেক্ট হিলশা’ গড়ে উঠেছে। আর শিমুলিয়া ঘাটে ভালো মানের অন্তত ১৫টি ইলিশের রেস্তোরাঁ রয়েছে। যেখানে রাতদিন দর্শনার্থী ও ভোজনরসিকদের ভিড় লেগেই আছে। এই উপজেলাতেই অন্তত পাঁচটি বিনোদন কেন্দ্র রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ পদ্মা সেতু এলাকা ও বাকি পর্যটন এলাকায় ঘুরতে আসেন। আর মাওয়ার পাশর্^বর্তী যশলদিয়া পানি শোধনাগারের মাধ্যমে প্রতিদিন পদ্মার কয়েক কোটি লিটার পানি যাচ্ছে রাজধানীতে। দেশের অন্যতম বৃহৎ ডেইরি ফার্মও এই উপজেলায়। কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছে এই এলাকাটি। এখানকার পদ্মা ইলিশ বাঙালির গর্ব। তাই ইলিশের কারণে শিমুলিয়া ঘাট এবং মাওয়া আরও সুপরিচিতি পেয়েছে।

পদ্মা তীর নদীভাঙন এই অঞ্চলের যেন অভিশাপ ছিল। পদ্মা সেতুর নদী শাসন ছাড়াও পৃথক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তাই স্থায়ীভাবে বাঁধ তৈরি কাজ শুরু হয়ে গেছে। সরকার ৪৪৬ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। লৌহজং থেকে ৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্প এই অঞ্চলের আশীর্বাদ। তবে এই প্রকল্পটি আরও কার্যকর করতে স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রচেষ্টায় আরও সাড়ে ৪ কিলোমিটারে স্থায়ী বাঁধ তৈরির প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায়।

বাস্তবে গত দেড় যুগে পাল্টে গেছে এই জনপদের চিত্র। আর পদ্মা সেতু ঘিরে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে এলাকাটিতে। পুনর্বাসন কেন্দ্রও বদলে দিয়েছে অনেক পরিবারের চিত্র। পুরো এলাকাটিই অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছে। মানুষের জীবন মানে বড় পরিবর্তন এসেছে। আর এই সেতু ঘিরে জমির দাম লাফিয়ে বাড়ছে। পদ্মা সেতুর মাওয়া টোল প্লাজার কাছেই বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খান সাহেবের বাড়ি। এই বাড়িরই সন্তান দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। এই এলাকায় মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ও তার পরিবারেরও অনেক অবদান। দীর্ঘদিন এই খান বাড়ি থেকেই সংসদ সদস্য হয়েছেন এই আসনটি থেকে।

পদ্মা সেতুর সড়ক নেটওয়ার্ক এবং রেল নেটওয়ার্ক ঘিরে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে এলাকাটি। টঙ্গীবাড়ির বেতকা থেকে ঢাকার তেঘরিয়া পর্যন্ত উদ্ভাবনী সড়ক বদলে দিচ্ছে গোটা এলাকা। বেতকায় নির্মাণ হয়েছে বৈদ্যুতিক বিশেষায়িত শিল্প নগরী। আলু ভিত্তিক অর্থনীতিতেও এই অঞ্চলের অবদান রয়েছে। টঙ্গীবাড়িতে এই সরকার বিএডিসির বিশেষায়িত হিমাগার নির্মাণ করেছে। টঙ্গীবাড়িতে চালু হওয়া মেরিন ইনস্টিটিউট আলোকবর্তিকা ছড়াচ্ছে। এসব নানা কারণেই আসনটিকে রাজনৈতিকভাবেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী চলতি বছরের শেষ দিকে হতে পারে জাতীয় নির্বাচন। সেই লক্ষ্যে এই আসনেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, স্বতন্ত্রসহ ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোতে মনোনয়ন নিয়ে চলছে নানা হিসেব-নিকেশ। নির্বাচনী প্রচারে বিএনপি মাঠে নেই তবে তারা সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ভেতরে ভেতরে একাধিক প্রার্থী নিজেদের প্রস্তুত রেখেছেন। আওয়ামী লীগেরও রয়েছে একাধিক প্রার্থী। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপরীতে আওয়ামী লীগই নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারে না থাকলেও নির্বাচন নিয়ে তাদের ব্যাপক আগ্রহ আছে। কেন্দ্রীয় নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। নির্দেশ পেলেই মাঠে নেমে প্রচার শুরু করবেন।

উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ধরে রাখার চেষ্টা করবে। পাশাপাশি বিএনপিও গুরুত্বপূর্ণ আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় আছে। এখন এখানকার গ্রামগঞ্জে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। নানাভাবে সম্ভাব্য সব দলের প্রার্থীই তাদের অবস্থান তুলে ধরার কৌশল অবলম্বন করছেন। ১৯৯১ সাল থেকে একটানা আসনটি বিএনপির দখলে ছিল। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে বিএনপির ঘাঁটিকে ম্লান করে দেয়। বিএনপির ঘাঁটি বর্তমানে পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও মুন্সীগঞ্জে বিএনপি বিজয়ী হয়। সেই অবস্থা এখন একেবারেই ভিন্ন।

জেলার লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার ২৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মুন্সীগঞ্জ-২ আসনে ভোটারের সংখ্যা ৩ লাখ ৫ হাজার ৯৮৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬৩ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৪ জন। মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। তিনি প্রথম ১৯৯৬ সালে সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির প্রার্থী মিজানুর রহমান সিনহার সঙ্গে ৭০ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি।

সবশেষ ২০০৮ সালে মোট ভোটের ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএনপির প্রার্থী সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীয় মিজানুর রহমান সিনহাকে হারিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। ২০১৪ সালে বিএনপি ভোট বর্জন করলে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন আহমেদকে হারিয়ে প্রায় ৯৪ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। এর আগে ১৯৯১, ১৯৯৬ ফেব্রুয়ারি (ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন), ১৯৯৬ জুন (সপ্তম) জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০০১ সালে আসনটি বিএনপির দখলে ছিল।

সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি টানা প্রায় ২৯ বছর ধরে এখানে নেতৃত্ব দিয়ে নিজের অবস্থান মজবুত করছেন। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নেও তার ভূমিকা রয়েছে। মাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণেও সাধারণের কোনো রকম ক্ষোভ প্রকাশ হয়নি। তিনি প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে জমি মালিকদের ঘরে ঘরে গিয়েছেন। দলকে গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি এলাকার জনগণের সুখ শান্তির জন্য ব্যাপক টেকসই উন্নয়নসহ সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন। তাই মাঠের রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি।

এই আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন- বর্তমান সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু ইউসুফ ফকির।

অপর দিকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চলমান আন্দোলনের পাশাপাশি ভোটের মাঠেও তৎপর বিএনপি। শেষ মুহূর্তে নির্বাচনের মাঠে দেখা যেতে পারে সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মিজানুর রহমান সিনহাকে। এলাকায় রয়েছে তারও বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা। বিএনপি থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীর আলোচনায় আরও আছেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বিশেষ স¤পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, ঢাকা বিভাগীয় কমিটির সাংগঠনিক স¤পাদক আবদুস সালাম আজাদ ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য আলী আজগর মল্লিক রিপন।

এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে চমক দেখাতে পারেন মেজর (অব) মাসুদুর রহমান কাইয়ুম। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায়ও এলাকার জন্য নানাভাবে কাজ করেছেন। আর এখন অবসর গ্রহণের পর কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান না করেই নিজেকে জানান দিচ্ছেন ভিন্নভাবে। আর জাতীয় পার্টি থেকে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য জামাল হোসেন ও নোমান মিয়া। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কে এম বিল্লাল হোসেন।

জনকন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.