মুন্সীগঞ্জ-৩: কে পাবেন নৌকার মনোনয়ন?

মোজাম্মেল হোসেন সজল: আগামী ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে (সদর-গজারিয়া) আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা তৎপর হয়ে উঠেছেন। সম্ভাব্য দুই শক্তিশালী প্রার্থী প্রায় প্রতিদিনই সরকারি অনুষ্ঠান ছাড়াও এলাকার দলীয় ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করছেন। প্রার্থীরা দোয়া ও সমর্থন চেয়ে নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন স্থানে ব্যানার-বিল বোর্ডও শোভা পাচ্ছে।

প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন, বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, বঙ্গবন্ধুর চিফ সিকিউরিটি গার্ড মো. মহিউদ্দিনের বড় ছেলে ও মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব।

এছাড়াও নাম শোনা যাচ্ছে যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদেরও।

তবে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস ও মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব।

বাঁ থেকে অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব ও নুর মোহাম্মদ।

রাজনৈতিক বিরোধে এই দুই প্রার্থীর পক্ষের সমর্থকরা গ্রুপে বিভক্ত। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার কারণে মুন্সীগঞ্জ সদর ও গজারিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মুন্সীগঞ্জ-৩ নির্বাচনী এলাকার দলীয় পদ-পদবীধারী নেতা ও বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অধিকাংশই রয়েছেন মেয়র বিপ্লবের পক্ষে।

কিন্তু বসে নেই সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসও। তিনিও তার অনুসারীদের নিয়ে দলীয় এবং সরকারি অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। মৃণাল কান্তি দাস দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য এবং ফয়সাল বিপ্লবও দুই মেয়াদে মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।

২০১৪ সালের ০৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস মুন্সীগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আগমন ঘটে। এই বছর বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় মেয়র ফয়সাল বিপ্লবের স্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। পরে কেন্দ্রীয় চাপে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিলে মৃণাল কান্তি দাস বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই থেকে মহিউদ্দিন পরিবার ও মৃণাল কান্তি দাসের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব।

পরের বছর ২০১৫ সালে ফয়সাল বিপ্লব নৌকার টিকিটে প্রথমবারের মতো মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগে একাধিকবার মুন্সীগঞ্জ পৌরসভায় এবং সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জয়ের মুখ দেখতে পাননি তিনি।

এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৃণাল কান্তি দাস আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ধানের শীষ প্রতীকের পাঁচ বারের নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল হাইকে পরাজিত করে। ২০২১ সালের নির্বাচনেও তিনি মেয়র নির্বাচিত হন ধানের শীষের প্রাথী শহিদুল ইসলামকে পরাজিত করে। শহিদুল ইসলাম দলীয় প্রতীক পেলেও নির্বাচনী কোন প্রচার-প্রচারণা চালাননি।

ফয়সাল বিপ্লব প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে পৌর কর বাড়িয়ে দেন এবং পৌর মার্কেটের টয়লেট বিক্রি করে দেন। তবে, এই দুই প্রার্থী দল ক্ষমতায় আসার পর এবং লাভজনক পদ পাওয়ার পর আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে স্থানীয়দের অভিমত।

এদিকে, বাবার উত্তরসূরী হিসেবে আগামীতে জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার নেয়ার লক্ষ্যে মেয়র বিপ্লব মাঠ গুছাচ্ছেন বলে তার অনুসারীদের মত। তিনি মুন্সীগঞ্জ-৩ নির্বাচনী এলাকা ছাড়াও সমগ্র জেলার দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন। মেয়র বিপ্লবের পরিবারের নেতৃত্বে চলছে জেলা আওয়ামী লীগ। তার বড় চাচা আনিছ-উজ্জামান আনিছ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। এছাড়াও আনিছ-উজ্জামান মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন একাধিকবার। বর্তমানে তিনি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

দলীয় বিরোধের কারণে মিরকাদিম পৌরসভায় একজনকে মেয়র বানানো নিয়েও সমালোচনায় রয়েছেন সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস। এই পৌরসভায় দুই মেয়াদে মেয়র ছিলেন শহিদুল ইসলাম শাহীন। একবার স্বতন্ত্র ও আরেক বার নৌকার টিকিটে মেয়র হন শাহীন।

বিএনপি ও বিকল্পধারা করা শহিদুল ইসলাম শাহীন সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তির সৃষ্টি। মৃণাল কান্তির হস্তক্ষেপে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির হাত ধরে শাহীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। যোগদানের পর নৌকা প্রতীক পেয়ে শাহীন দ্বিতীয় মেয়াদে মিরকাদিম পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন ঘিরে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর নির্বাচন করায় শাহীনের সঙ্গে সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসের তীব্র বিরোধ দেখা দেয় বলে জানান শাহীন। এরপর নানা কারণে তাদের মধ্যে বিরোধ আরও তুঙ্গে উঠে।

গত পৌর নির্বাচনে শাহীনের প্রার্থীতা নিয়ে তার বিরুদ্ধে নামেন সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস। শেষ অবধি মনছুর আহমেদ কালাম ও শহিদুল ইসলাম শাহীন-এই দু’জনের প্রার্থী হওয়া নিয়ে শুরু হয় লবিং-গ্রুপিং। চরম বিরোধের কারণে শেষ মুহুর্তে কেন্দ্র থেকে দু’জনকে মনোনয়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত হলে আব্দুস সালাম নামে এক কমিশনার প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক দেয়া হয়। শাহীন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন জমা দিয়ে তা প্রত্যাহার করে নেন। শেষ পর্যন্ত সালাম জয়ী হন।

সালাম এলাকায় পিঠা সালাম নামে পরিচিত। প্রথম শ্রেণীর একটি পৗরসভায় এ রকম এক বকলম মেয়র নিয়ে মিরকাদিম পৌরবাসী ক্ষুব্ধ। নির্বাচনের পর ব্যাপক বিরোধীতা করার পরও শহিদুল ইসলাম শাহীন মিরকাদিম পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

আবার পঞ্চসার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসের চরম বিরোধীতা থাকা সত্বেও একবার জেলে থেকে আরেকবার স্বশরীরে নির্বাচন করে দুই মেয়াদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন গোলাম মোস্তফা। বিপুল জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত পঞ্চসার ইউনিয়নটি এই নির্বাচনী আসনের তিন-চার ইউনিয়নের সমান ভোট। এই ইউনিয়নের ভোটার প্রায় ৬০ হাজার।

সাবেক মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহীন ও ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা দু’জনই রয়েছেন মেয়র ফয়সাল বিপ্লবের পক্ষে।
দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য হওয়ার পরও চোখে পড়ার মতো কোন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখাতে পারেননি বলে নাগরিকদের অভিযোগ।

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়াবাসীর দীর্ঘ সময়ের দাবি ফুলদি নদীর ওপর ব্রিজ, মেঘনা নদীর ওপর ব্রিজ, পৌরসভার চরকিশোরগঞ্জ খালের ওপর ব্রিজ এবং মুক্তারপুর থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত সড়ক পথের উন্নয়ন- কোনোটিই করতে পারেননি তিনি।

চরকিশোরগঞ্জবাসীর অভিযোগ, মেয়র ও সংসদ সদস্যের বিরোধে তারা ব্রিজ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

এদিকে, অসমাপ্ত শিশু পার্কে, হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকায় ঘন ঘন মেলা বসানো, পৌরসভাসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারে লাভজনক আছেন মেয়র ফয়সাল বিপ্লব। তবে, মেয়র হওয়ার পর পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় নতুন সড়ক নির্মাণ, পুরাতন সড়কে সংস্কার-মেরামত এবং সড়ক বাতির ব্যবস্থা করেছেন।

শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে হাটলক্ষ্মীগঞ্জের সড়কটি বেহাল দশা দীর্ঘদিন ধরে। এই ওয়ার্ডের কমিশনার সংসদ সদস্য গ্রুপের হওয়ায় মেরামত না করায় মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লঞ্চে চলাচলরত যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

এছাড়াও, প্রার্থী হিসেবে আকস্মিক নাম শোনা যাচ্ছে যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদের। তাকে সবাই জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবে জানেন। এরশাদের জামানায় জাতীয় পার্টির টিকিটে ১৯৮৮ সালে ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে নূর মোহাম্মদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। নূর মোহাম্মদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের অনুসারী।

দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এই আসনটিতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক গতি আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়। সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব এম ইদ্রিস আলী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী প্রয়াত এম শামসুল ইসলামকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর মুন্সীগঞ্জ সদরের চরাঞ্চলের সন্ত্রাস বন্ধে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে চরকে শান্ত করে দেন। দলীয় কোনো সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজের প্রশ্রয় দেননি তিনি।

অবজারভার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.