ফুল নীতি, ফুল কঠিন হৃদয়কেও কোমল করে দেয় ।

রাহমান মনি: “ও ভাই, ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে-
গোলাগুলির গোলেতে নয়, গভীর ভালোবেসে।
খড়ুগ, সায়ক, শাণিত তরবার,
কতটুকুন সাধ্য তাহার, কি বা তাহার ধার?
শত্রুকে সে জিনতে পারে, কিনতে নারে যে সে-
ও তার স্বভাব সর্বনেশে।
ভালোবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়-
সে যে সৃজন পরিচয়।
শত আঘাত-ব্যথা-অপমান লয় সে কোলে এসে,
মৃত্যুরে সে বন্ধু বলে জাপটে ধরে শেষে” ।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী’র ‘ভালবাসার জয়’ কবিতাটি পড়ার পর প্রতিটি বাক্য রপ্ত করে মেনে চলার চেষ্টা করে আসছি আজও।

সবুজায়নের প্রতি আগ্রহ ছিল শৈশবকাল থেকেই । বাড়ির আঙিনার স্বল্প যায়গাতেও অপরিকল্পিত ফুল, ফল কিংবা শাকসবজি’র চারা বুনন করার অভ্যাসটা এই জাপানেও চলমান রয়েছে।

ছোট কামরার ভাড়াটে এই প্রবাস জীবনে প্রথম প্রথম জানালার এককৌনে ছোট্ট টবে কাঁচামরিচ এর চারা দিয়ে পুড়নো অভ্যাসটাকে চলমান রেখে আসছি ।

২০০০ সালে বর্তমান বাসায় আসার পর বারান্দা বেশ বড় হওয়ায় কিছু ফুলের চারার পাশাপাশি সবজির চারা রোপণ করলে বেশ ভাল সাফল্যতা আসে। সেই থেকে প্রতি বছর বেশ উৎসাহ নিয়ে ‘বারান্দা কৃষি’ নাম দিয়ে সফলতার সাথে চাষাবাদ করে আসছি।

আমার মতো আরো যারা প্রবাসী সৌখিন চাষি রয়েছেন তাদের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম দুলাল এবং শাহ হোসাইন শাহু ভাই-এর সাথে সব সময় অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে একে অপরের ছোট ছোট সমস্যাগুলো দূর করার চেষ্টা করে সামনে এগুচ্ছি ।

এর-ই মধ্যে ২০২২ সালে এক সন্ধ্যায় কথাচ্ছলে হঠাত করে বসবাসরত ইমারত এর পাশে একটি খালি যায়গাতে মরিচ গাছ রোপণ করলে, ৩/৪ দিন পর কে বা কাহারা চারাটি উপড়ে ফেলে ।

কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের “উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ” কিংবা কালীপ্রসন্ন ঘোষ-এর “একবার না পারিলে দেখ শতবার” -এ ব্রত হয়ে আবারো একাধিক নতুন চারা রোপণ করি । আবারো সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

দমে না গিয়ে নতুন করে ধারনা বদলে পুরো যায়গার আগাছা পরিস্কার করে মরিচ গাছের সাথে ফুলের চারার সংযোজন করে আরও বড় পরিসরে শুরু করি । এই ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা করেন মিলন ভাই এবং বেলাল মামা । প্রতিদিন পানি দেয়া সহ পরিচর্যা এবং দেখভাল করতে থাকি ।

প্রথম প্রথম চারাগুলো ছোট থাকায় কারোর নজর কাড়তে পারেনি । বড় হয়ে ফুল ফুটে যখন আপন সৌন্দর্য/সৌরভ ছড়াতে শুরু করে তখন পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয় । অনেকে খানিকটা দাঁড়িয়ে চোখ জুড়ান । কেহবা মোবাইল ফোনে ক্লিক করে নেন ।

রোববার একদিন বেলাল মামা আর আমি মিলে আগাছা পরিষ্কার করার সময় একই বাসভবনের এক প্রতিবেশী (বয়স্কা মহিলা ) ছোট্ট একটি থলে নিয়ে হাজির । থলে থেকে পানির কলের চাবি বের করে এগিয়ে দিয়ে বলেন, রাহমান সান (মিঃ রাহমান), ‘তুমি অনেক কষ্ট করে ৩ তলা থেকে পানি এনে ফুল গাছে দাও , এখন থেকে আর কষ্ট করতে হবে না , এই নাও কলের চাবি । এখন থেকে এখান থেকেই পানি দিবে , যতো খুশী , যখন তখন’ ।

আমি অবাক তো বটেই , একই সাথে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। স্তম্ভিত ফিরে পেলে বিনয়ের সাথে জানতে চাই , হটাত তোমার এতো পরিবর্তন কেন ? তুমি তো সচরাচর এমনটি নও ।

( বলা বাহুল্য , এই মহিলা সব সময় বিদেশীদের পাছনে লেগেই থাকে । সব কিছুতেই ভুল ধরা যার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট ( খাটি বাংলায় দুষ্ট বুড়ি ) এবং এই পানি ব্যবহার করলে তার বিল বিল্ডিং মেনটেনেন্স থেকে খরচ হবে যার ভুক্তিভুগি হবেন তিনি নিজেও, সে কিনা পানি ব্যবহার করার জন্য নিজ হাতেই চাবি দিয়ে দিচ্ছেন !)।

জবাবে তিনি বলেন , মেধা, অর্থ, সময় এবং শ্রম দিয়ে বাসকৃত এই বিল্ডিংটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছো , তার উপর ৩ তলা থেকে পানি বহন করে এখানে দাও তা সত্যি কষ্টকর। তাই , চাবি দিয়ে দিচ্ছি । তোমার সুবিধা মতো —–।

ফুলের সৌন্দর্য যে কঠিন হৃদয়ের মানুষকেও প্রভাবিত করে কোমল করে তুলে তা বাংলা সিনেমা , নাটক, গল্পে শুনেছি , দেখেছি । আজ বাস্তবে দেখার সৌভাগ্য হ’লো । ভাবতেই ভালো লাগছে ।

“ভালোবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়-
সে যে সৃজন পরিচয়”।

rahmanmoni@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.