রাহমান মনি: নামে টোকিও বৈশাখী মেলা হলেও এটি আসলে জাপান প্রবাসীদের প্রাণের মেলা। এই মেলাকে ঘিরে জাপান প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস কাজ করে বরাবরই। এবার তার সঙ্গে যোগ হয় উৎকণ্ঠা। তার অন্যতম কারণ ছিল আবহাওয়ার পূর্বাভাস। জাপান আবহাওয়া বিভাগ দুই সপ্তাহ আগেই জানিয়ে দিয়েছিল যে বৈরী আবহাওয়া থাকবে। নিম্নচাপজনিত কারণে বৃষ্টি এবং তার সঙ্গে যোগ হবে প্রবল বাতাস। তবে দুপুরের পর সব কেটে যাবে।
প্রতি বছরের মতো এবারও টোকিওর তোশিমা সিটি ইকেবুকুরো নিশিগুর্চি পার্কে বসেছিল জাপান প্রবাসীদের মিলনমেলার হাট। ১৭ এপ্রিল ২০১৬ রোববার ইকেবুকুরো এলাকাটি হয়েছিল এক টুকরো বাংলাদেশ। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলা ভাষা, মানুষ দেখেছে বাংলাদেশিদের পোশাক সংস্কৃতি, স্বাদ নিয়েছে বাংলাদেশের খাদ্য সংস্কৃতির এবং উপভোগ করেছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংস্কৃতি। এদিন বর্ণিল সাজে সেজেছিল শহীদ মিনার খ্যাত ইকেবুকুরো নিশিগুর্চি পার্ক।
এই পার্কেই স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ সরকারি অর্থায়নে দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার। তাই নতুন কোনো জাপানি যিনি টোকিওর বাইরে থাকেন, তাকে যদি বৈশাখী মেলার দিন মেলা প্রাঙ্গণে ছেড়ে দেয়া যায় তাহলে নির্ঘাত তিনি দ্বিধায় পড়ে যাবেন যে, তিনি আসলেই নিজ দেশে আছেন, নাকি বিনা টিকেট, পাসপোর্ট, ভিসাবিহীন স্বপ্ন দেখার মতো তৃতীয় কোনো দেশে অবস্থান করছেন।
জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই মহা মিলনমেলায় শুধু যে বাংলাদেশিরা অংশ নিয়ে থাকেন বা আনন্দ উপভোগ করেন তা কিন্তু নয়। স্থানীয় জাপানিদের বিপুল অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের নাগরিকগণ এতে অংশ নিয়ে থাকেন এবং উপভোগ করে থাকেন। আর মেলাটি উন্মুক্ত পার্কে অনুষ্ঠিত হয় বলে অনেক ভ্রাম্যমাণ দর্শনার্থীরও পদধূলি পড়ে বাংলাদেশিদের এই মেলায়।
এবারের আয়োজনটি ছিল সপ্তদশ বা ১৭তম। মেলার মধ্যে এবারের খাবারের স্টল ছিল ২৩টি। এছাড়াও ১৭টি অন্যান্য (অ্যাপারেল, আইটি, পোশাক, বই, হস্তশিল্প, কুটির শিল্প, চামড়া শিল্প) মিলিয়ে মোট ৪০টি স্টল স্থান পেয়েছে ১৭তম এই আয়োজনে।
বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও সপ্তদশ টোকিও বৈশাখী মেলা ও কারি ফেস্টিভ্যাল সকাল ১০টায় যথারীতি উদ্বোধন করা হয়। রবীঠাকুরের সেই বিখ্যাত গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ দিয়ে মেলা উদ্বোধন হয়। এ সময় মঞ্চের শিল্পীবৃন্দ ছাড়াও মেলায় আগত দর্শনার্থীরাও সুর মেলান। সবার মধ্যে প্রবাসের মাটিতেও এক নিজস্বতা পরিলক্ষিত হয় এ সময়।
মেলা উদ্বোধনী ও বিভিন্ন ঘোষণার পর শুরু হয় বড়দের ওপেন প্রোগ্রাম। এই অনুষ্ঠানটি মূলত সংগীতশিল্পী, সংগঠক ও মেলার সমন্বয়কারী তানিয়া ইসলাম মিথুনের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় হয়ে থাকে প্রতিবছর। নতুনরা এখানে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান। এবারও বেশ কয়েকজন নতুন মুখ দেখা গেছে এই আয়োজনে।
নতুন মুখদের মধ্যে মেলায় প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে অ্যাডভোকেট হাসিনা বেগম রেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি আবৃত্তি করে আবৃত্তিতে তার শক্ত অবস্থানের কথা জানান দেন। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তার আবৃত্তি শোনেন।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে এ বছর শিশু-কিশোরদের উন্মুক্ত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাটি সম্ভব হয়নি। তবে তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি ছিল উপভোগ্য। বরাবরের মতো এবারও শিশুদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি আয়োজনে ছিল প্রবাসী কল্যাণ সমিতি জাপান। আর এটি পরিচালনা করেন ববিতা পোদ্দার এবং এ জেড এম জালাল। রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা কর্তৃক শিশুদের হাতে উপহার তুলে দেয়ার কথা থাকলেও বিলম্বে আসার কারণে মেলার প্রধান সমন্বয়কারী ড. শেখ আলীমুজ্জামান শিশুদের হাতে উপহার তুলে দেন।
জাপানি বাদ্য দল সাসি সেন-এর ঢোল বাজনা বৃষ্টির কারণে কিছুটা ছোট করলেও প্রতিবারের মতো এবারও উপভোগ্য ছিল। এবার অনেক নতুন মুখ দেখা যায়।
ড. নোরিকো কিনুকাওয়ার পরিচালনায় অতিথি বরণ পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। বিশেষ অতিথি ছিলেন আয়োজক সংগঠন জাপান বাংলাদেশ সোসাইটি (জেবিএস) এর চেয়ারম্যান ড. ওসামু ওৎসুবো, স্থানীয় প্রশাসন তোশিমা সিটি ডেপুটি মেয়র মাসাহিকো মিজুশিমা, সংসদ সদস্য এবং প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী হাকুবুন শিমোমুরা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ব্যস্ততার কারণে তার অফিস সেক্রেটারি এবং ছেলে কেনতা শিমোমুরা তার ম্যাসেজ পাঠ করে শোনান।
প্রধান অতিথি রাবাব ফাতিমা বলেন, প্রবাসে এমন একটি আয়োজন পেয়ে আমি সত্যি অভিভূত। আয়োজকদের আমি ধন্যবাদ জানাই। বৈশাখী মেলা আপনাদের সবাইকে এক হবার সুযোগ করে দেয়। আপনাদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও এই মেলার মাধ্যমে ভেদাভেদ ভুলে নিজ সংস্কৃতি জাপানের মাটিতে তুলে ধরবেন বলে আমি আশা করি। রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি জাপানের কুমামোতোতে ভূমিকম্পে হতাহত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের গভীর সমবেদনা জানান।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও স্থানীয় দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠন উত্তরণ এবং স্বরলিপি সংগীত পরিবেশন করে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর উভয় সংগঠনেরই গান নির্বাচন এবং স্টেজ পারফরম্যান্স ভালো ছিল দর্শক উপভোগ করেছে।
সবশেষে বিকেল ৪টায় শুরু হয় বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত শিল্পীদের গান। এ বছর টোকিও বৈশাখী মেলার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠের লুইপা এবং ক্লোজআপ ওয়ান তারকা মুহিন। মুহিন কিছুটা সামাল দিতে পারলেও লুইপা ছিল সম্পূর্ণ বেসামাল।
সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ছিল অতিরিক্ত কথা বলা। শিল্পীদের অতিরিক্ত কথায় মনে হয়েছে তারা প্রবাসীদের আমন্ত্রণে এখানে গান গাইতে আসেননি। শহরের কোনো স্থানে ফুটপাতে মজমার আসর বসিয়েছেন।
টোকিও বৈশাখী মেলায় এ বছর উপস্থাপনা প্যানেলে জুয়েল আহসান কামরুল, নারমীন হক, মনজুর মাহতাব, তানিয়া ইসলাম মিথুন এবং ড. কিনুকাওয়া নোরিকো ছিলেন।
টোকিও বৈশাখী মেলা জাপান প্রবাসীদের সর্ববৃহৎ মিলন মেলা। নির্দিষ্ট একটি দিনে মেলাটি অনুষ্ঠিত হলেও মেলাকে ঘিরে প্রবাসীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করে বেশ কিছুদিন পূর্ব থেকেই। আর রেশও থাকে বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা টোকিও বৈশাখী মেলা উপভোগ করেন। এক সময় জাপান প্রবাসী ছিলেন তখন অন্য দেশে বা বাংলাদেশে বসবাস করেন এমন অনেকেই বৈশাখী মেলাকে ঘিরে জাপান সফর করেন।
ড. শেখ আলীমুজ্জামানের নেতৃত্বে একদল কর্মীবাহিনীর নিরলস প্রচেষ্টায় সার্থক হয় এই মেলা। পিছনে থাকে অনেকের সমর্থন এবং সহযোগিতা। সকলেই ধন্যবাদ প্রাপ্য।
বিদায় বেলা সবার মুখে একই বাক্য, দেখা হবে আগামী মেলায়।
সাপ্তাহিক
Leave a Reply