সারা বছর অবহেলাতেই পড়ে থাকে মুন্সীগঞ্জের বধ্যভূমিগুলো। বিশেষ কোন দিন কিংবা অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হলেই সেগুলো পরিষ্কার করা হয়। সদরের সাতানিখীল, কেওয়ার, টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আব্দুল্লাহপুর, গজারিয়া উপজেলার নয়ানগর, গোসাইচর, বালুরচর, নাগেরচর, কাজিপুরা, বাশগাঁওসহ অনেক জায়গাতেই হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এসব জায়গায় আজও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি।
কলেজের প্রাক্তন ছাত্র সাজ্জাদ হোসাইন জানান, ২০০৬ সালে হরগংগা কলেজের দেওয়া ২০ শতাংশ জায়গায় ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় জেলার কেন্দ্রীয় বধ্যভূমি, যেখানে রয়েছে ৩৬ জনের লাশ। কিন্তু তাও জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দুই পাশে সীমানা দেয়াল নেই, চারপাশে খোলামেলা ভাবেই অবস্থান করছে এটি। রাতের অন্ধাকারে এখানে চলে মাদক সেবন। শুধু ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে সামনে রেখে তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।
এই ব্যাপারে হরগংগা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রক্তন শিক্ষক নাজমুল হাসান জানান, বধ্যভূমিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। ১৪ ডিসেম্বর আসলেই তারা শুধু এদিকে নজর দেয়। আমরা চিঠিপত্র দিয়ে একাধিকবার জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছিলাম কিন্তু তারা এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা পালন করছে না। বধ্যভূমিতে একটি সীমানা প্রাচীর দিয়ে রক্ষা করা যেতে পারে, কিন্তু এই ব্যাপারটি তারা আমলেও নিচ্ছে না। এর ফলে নানারকম অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে।
একই কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুখেন চন্দ ব্যানার্জী জানান, পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের ১৩ মে রাত সাড়ে ৩টার দিকে মুন্সীগঞ্জ সদরের কেওয়ার চৌধুরী বাড়ি ঘেরাও করে। ওই বাড়ি থেকে ডা. সুরেন্দ চন্দ্র সাহা ও তার দুই ছেলে শিক্ষক সুনিল কুমার সাহা, দ্বিজেন্দ্র লাল সাহা এবং অধ্যাপক সুরেশ ভট্টাচার্য, শিক্ষক দেব প্রসাদ ভট্টাচার্য, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর শচীন্দ্র নাথ মুখার্জীসহ ১৭ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায় এবং ১৪ মে সকাল ১০টায় কেওয়ার সাতানিখীল গ্রামের খালের পাড়ে চোখ বেঁধে ১৬ জনকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে। ড. সুরেন্দ চন্দ্র সাহাকে হরগংগা কলেজের পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে পাঁচঘড়িয়াকান্দি গ্রামের একটি আম গাছে ঝুলিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়।
সরকারি হরগংগা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রবীল কুমার গাঙ্গুলী জানান, পাছ ঘড়িয়াকান্দির একটি আম বাগানে ২৫-৩০ জনকে হানাদার বাহিনী মেরে ফেলে। সাতানিখীল এলাকাতেও তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়। আব্দুল্লাহপুরের পালবাড়ি বধ্যভূমিটিও সংরক্ষণ করা হয়নি। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯ জনকে হত্যা করে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর সেখানে আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহীদ মোল্লা একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করে পালবাড়ি পুকুর পাড়ে। কিন্তু তাও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
গজারিয়া উপজেলার নয়ানগর, গোসাইচর, বালুরচর, নাগেরচর, কাজিপুরা, বাশগাঁওসহ অনেক জায়গাতেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৩৬০ জন বাঙালিকে হত্যা করে। ৩৬০ জনের মধ্যে ১০৩ জনের নাম পরিচয় জানা গেলেও বাকি ২৫৭ জনের নাম স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও জানা সম্ভব হয়নি। উপজেলার ১০টি বধ্যভূমি অরক্ষিত ও অবহেলায় পড়ে আছে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনিসুজ্জামান আনিস জানান, মোটামুটিভাবে সবগুলো বধ্যভূমি চিহ্নিত করা গেছে। তবে আর্থিক কোন বরাদ্দ না থাকায় বধ্যভূমি সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। মুন্সীগঞ্জের সকল বধ্যভূমি সংরক্ষণে ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা জানান, এটা সত্যি বধ্যভূমিগুলো সারা বছর অবহেলায় পড়ে থাকে। পরবর্তী মিটিংয়ে সবার সাথে কথা বলে বধ্যভূমি সংরক্ষনের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিব। আপনাদের (সাংবাদিকদের) পক্ষ থেকে কোন পরামর্শ থাকলে বলবেন; সময় উপযোগী সব ধরনের ব্যবস্থা নিব।
দ্য রিপোর্ট
Leave a Reply