কোন্দলে জর্জরিত মুন্সীগঞ্জ আওয়ামী লীগ

মোজাম্মেল হোসেন সজলঃ নানাভাবে বিভক্ত মুন্সীগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সুযোগ-সুবিধা আর আধিপত্য বিস্তারে দলটির নেতাকর্মীরা গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং জেলার তিন সংসদ সদস্যকে ঘিরেই মূলত এই গ্রুপের সৃষ্টি। স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগও শীর্ষ নেতাদের খবরদারিতেই চলছে।

জেলার শ্রীনগর উপজেলায় উপজেলা ও শ্রীনগর সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ এবং গজারিয়া উপজেলায় রয়েছে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি কমিটি। যদিও জেলা ছাত্রলীগ ওইসব উপজেলায় একটি করে কমিটিই অনুমোদন দিয়েছেন। সদর উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই গ্রুপে বিভক্ত। সভাপতি ফয়সাল মৃধার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসসহ নানা অভিযোগ। থানায় মামলা রয়েছে একাধিক।

গত কয়েকদিন আগে ওইসব মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে। এরপর জামিনে মুক্ত হয়েছেন। জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহম্মেদ পাবেল স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদকের বলয়ে থেকে কাজ করছেন।

২০০৪ সালে আক্তারুজ্জামান রাজীবকে সভাপতি ও ফেরদৌস হালদারকে সাধারণ সম্পাদক করে মুন্সীগঞ্জ জেলা যুবলীগের কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটি দিয়েই চলছে জেলা যুবলীগ। জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রয়েছেন। দীর্ঘ বছরেও জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। আহ্বায়ক পদে রয়েছেন আল-মাহমুদ বাবু। কৃষকলীগের অবস্থাও একই। নতুন কমিটি নেই দীর্ঘ বছর ধরে। জেলার ৬টি উপজেলা ও দুইটি পৌরসভা আওয়ামী লীগে বিরাজ করছে অস্থিরতা। পেশি শক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগকে কুক্ষিগত করে রাখার অভিযোগ দলীয় কর্মীদের। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির পছন্দের ব্যক্তিরাই রয়েছেন জেলার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটির বিভিন্ন পদে। বিভিন্ন উপজেলায়ও আওয়ামী লীগ গ্রুপের রাজনীতিতে আক্রান্ত। সবমিলিয়ে কোন্দলে কোন্দলে বিপর্যস্ত মুন্সীগঞ্জ আওয়ামী লীগ। আবার মুন্সীগঞ্জ আওয়ামী লীগ এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যরাই অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিভক্ত করে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে,দলীয় কোন্দল প্রকট হলেও আগের চেয়ে মুন্সীগঞ্জে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ২০০৮ সালের পর মুন্সীগঞ্জে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আবার বিএনপি-জামায়াত জোটেরও অনেকে আওয়ামীলীগের সঙ্গ নিচ্ছেন। এদিকে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মুন্সীগঞ্জ-২ নির্বাচনী (টঙ্গীবাড়ী-লৌহজং) এলাকায় কাজ শুরু করেছেন এটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, সদর ও গজারিয়া মিলে মুন্সীগঞ্জ-৩ নির্বাচনী এলাকা। এখানে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস গ্রুপের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এই আসনে বিগত নির্বাচনগুলোতে জেলা আওয়ামী লীগ দলীয় টিকিট পেয়ে নির্বাচন করতেন। একক ক্ষমতার খর্ব হওয়ায় তারা অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাসকে মানতে পারছেন না বলে মৃণাল সমর্থকদের অভিযোগ। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিন পরিবারের স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন, ভাতিজা ও ছেলে সবাই রয়েছেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। এ ক্ষেত্রে পদ-পদবীতে পিছিয়ে আছে সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস গ্রুপের লোকজন। তাদের এই বিরোধে মুন্সীগঞ্জ সদর ও গজারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগও বিভক্ত। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কখনও মৃণাল কান্তি দাস আবার কখনও মোহাম্মদ মহিউদ্দিন অনুসারি বনছেন। গজারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংসদ সদস্য গ্রুপের উপজেলা চেয়ারম্যান রেফায়েত উল্লাহ খান তোতা এবং আরেক গ্রুপে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোলাইমান দেওয়ান এবং সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম।

টঙ্গীবাড়ী ও লৌহজং উপজেলা আওয়ামী লীগের একক নিয়ন্ত্রণভারে রয়েছেন মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি। লৌহজং উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রবীন রাজনীতিক ফকির মো. আব্দুল হামিদকে কোনঠাসা করে রেখেছেন সংসদ সদস্য এমিলি গ্রুপ। এই উপজেলার একক নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছেন সংসদ সদস্য এমিলি সমর্থক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশীদ সিকদার গ্রুপ। টঙ্গীবাড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের এক পক্ষে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান ও উপজেলা চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার কাজী ওয়াহিদ। অপর পক্ষে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জগলুল হালদার ভুতু এবং সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আল-আসাদ বারেক।

শ্রীনগর ও সিরাজদিখান উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একক ক্ষমতাধর হচ্ছেন মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ। এখানে সংসদ সদস্য ও তার সমর্থকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আওয়ামী লীগ পরিচালিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এ কারণে এই নির্বাচনী এলাকার দুইটি উপজেলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ভয়াবহ কোন্দল ও সহিংস-রক্তপাতে জড়িত। স্থানীয় সংসদ সদস্য সিরাজদিখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম সোহরাবসহ আরও কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান দিয়ে রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্ঠা করছেন। এদের সাথে রয়েছে আরও যুবলীগ-ছাত্রলীগ নামধারী আরও কিছু অপরাধী। অপরদিকে, সংসদ সদস্য বিরোধী আরেক অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো.মহিউদ্দিন গ্রুপ। সংসদ সদস্যের নিজ উপজেলা শ্রীনগর উপজেলার অবস্থা আরও ভয়াবহ। শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেনসহ কয়েকজনকে দিয়ে শ্রীনগরের রাজনীতি এককভাবে চালাচ্ছেন সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ। সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জণ ঘোষ শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

সংসদ সদস্যের একক আধিপত্য রুখে দিতে শ্রীনগরের মাঠে রয়েছেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার কবির। ইতোমধ্যে সংসদ সদস্য ও গোলাম সারোয়ার কবির গ্রুপের মধ্যে শ্রীনগরে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা এবং থানায় মামলা হয়েছে।

প্রতিপক্ষের গোলাম সারোয়ার কবির সমর্থকদের অভিযোগ, রাজনীতির নিয়ন্ত্রণভার এককভাবে রাখার লক্ষে কিছু সন্ত্রাসী দিয়ে শ্রীনগরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চালানো হচ্ছে। এসব সন্ত্রাসীরা সুকুমারের পক্ষে কাজ করে দলকে বিতর্কিত করছে।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা গোলাম সারোয়ার কবির বলেছেন, শ্রীনগর উপজেলা ও শ্রীনগর সরকারি কলেজে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আমার ও সুকুমার দাদার সঙ্গে সম্বনয় করে কমিটি দেয়। কিন্তু আমার লোক ভেবে দুই কমিটি থেকে দুইজনকে বাদ দিয়ে সুকুমার রঞ্জন ঘোষ দুই কমিটি ঘোষণা দেন। আমি কোনো গ্রুপিয়ের রাজনীতি করি না। দলের পক্ষে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। আগামী নির্বাচনে দল আমাকে বা সুকুমার রঞ্জণ ঘোষ কিংবা তৃতীয় কারও নমিনেশন দিলে আমরা তার পক্ষেই কাজ করবো।

এদিকে, দলীয় কোন্দল, সংঘাত বাড়তে থাকলে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত হলে দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে বেগ পেতে হবে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের অভিযোগ।

জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহম্মেদ পাবেল জানিয়েছেন, ছাত্রলীগে কোথাও কোনো গ্রুপিং নেই। সংসদ সদস্যের পক্ষে থাকলেও মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার বাইরে গিয়ে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ফয়সাল মৃধা যদি চান, তাহলে মহিউদ্দিন সাহেবকে নিয়ে গ্রুপ করুক। শ্রীনগর ও সিরাজদিখানের ছাত্রলীগ প্রসঙ্গে জেলা ছাত্রলীগের এই নেতা জানান, সেখানে গোলাম সারোয়ার ও সুকুমার গ্রুপ থাকতে পারে। কিন্তু ছাত্রলীগে কোনো গ্রুপিং এবং একাধিক কমিটি নেই।

এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। ছাত্রলীগ, যুবলীগ আওয়ামী লীগের কোন সহযোগী বা অঙ্গসংগঠন নয়। নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সেন্ট্রাল কমিটি।

ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করলে জেলা আওয়ামী লীগ কাউকে বহিস্কার করতে পারবে বা মর্মে কেন্দ্রের নির্দেশনা রয়েছে। গেলো ইউপি নির্বাচনে দলীয় বিদ্রোহীর সংখ্যা ছিলো অনেক বেশি।

তিনি আরও বলেন, ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করলে বহিষ্কার করা না করা যেমন ভালো, তেমনি খারাপও। ডিসিপ্লিন বাহিনী ছোট হলেও ভালো। বহিষ্কার করার ক্ষমতা না থাকায় তারা ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করছে। তাদের ধারণা, ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করলেতো আর কিছু হয় না।

পূর্ব পশ্চিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.