হুমায়ূন আজাদ-এর কবিতা লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, অলৌকিক ইস্টিমার -এর প্রকাশ ১৯৭৩ সনে। প্রথম বইতেই তাঁর পাকা হাতের স্বাক্ষর এবং এই রচনাগুলোতেই তাঁর কবিতার ভাবনার প্রধান স্রোত এবং টেকনিক, যা পরে আরও কিছু বিস্তৃত হয়েছিলো, তার সবই আছে। সেই জন্য এই গ্রন্থের কবিতাগুলোকে মনোযোগ দিয়ে পড়া দরকার। প্রথম কবিতা, ‘স্নানের জন্য’-এ তাঁর উক্তি : “আমি কি ক’রে ভাসাই নৌকো জলে নামি স্নান করি …… পেছনে স্বভাব কবির কন্ঠনিঃসৃত পদ্যের মতোন ধুঁয়ো ওঠে কারখানার চিমনি চিরে …বড্ডো ময়লা জমে গেছে এ-শরীরে স্নান তাই অতি আবশ্যক… “। স্নান প্রতীকী । প্রচলিত কবিতার প্রতি তাঁর কটুক্তি এবং তিনি যে কিছু করতে চান সে উদ্যাোগ বর্তমান।
১. অলৌকিক ইস্টিমার-এ আজাদ এই সব বিষয়ে, আবহে, টেকনিকে কবিতা লিখেছেন :
• স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের জীবনের মধ্যে দিয়ে সামাজিক সমস্যা, অনিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ সংকট। / [ ‘জল দাও বাতাস –জননী,আমার সন্তান’, ‘আমার কন্যার জন্য প্রার্থনা’ ]
স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের জীবনের মধ্যে দিয়ে সামাজিক সমস্যা, অনিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ সংকট – এ ক্ষেত্রটি খুব সাহসের, অন্তত বলার দিক থেকে। আজাদ ছাড়া অন্য সমসাময়িক কেউ এ-ধরণের কবিতা লেখেন নি। ‘জল দাও, বাতাস’-এর তিনটি কবিতা – ‘জননী’, ‘আমার সন্তান’, ‘আমার কন্যার জন্য প্রার্থনা’ – এই আশংকা, সামাজিক অধঃপতনের আভাষ। ‘জননী’ পাকা অক্ষরবৃত্তে সনেট, বাকি দুটো গদ্য-কবিতা। দ্বিতীয় কবিতার শুরু, “আমার সন্তান যাবে অধঃপাতে, চন্দ্রলোকে নীল বন তাকে মোহিত করবে না। কেবল হোঁচট খাবে রাস্তায় সিঁড়িতে ড্রয়িং রুমে সমভূমি মনে হবে বন্ধুর পাহাড় …”। আরও অধঃপতনের বিস্তারের পরে সব শেষে জিজ্ঞাসা, “ তুমি কি আসবে ওগো স্নিগ্ধ দিব্য প্রসন্ন সন্তান পতনকে লক্ষ্য ক’রে …”।
কখনো শোনাই গান নিজকন্ঠে, কখনোবা গ্রামোফোন খুলে,
কবিতা শোনাই তারে; নবীদের বিবিদের পুণ্য উপকথা;
শাসাবের কাছ থেকে মেগে আনা তাবিজটা বেঁধে দিই চুলে,
আতর লোবান সেন্টে আমোদিত সারাগৃহ সর্বত্র সততা।
[ জল দাও, বাতাস / অলৌকিক ইস্টিমার ]
সর্ববিধ সযতনের পরে, “কেবল জঞ্জাল জন্মে সুস্থতম মেয়েটির পেটের ভিতর”।
• কিছু পরাবাস্তব ধরণের কবিতা, অনেকটা আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর ধরণে। / [ ‘আজ রাতে’ ; ‘টয়লেট’; ‘মধ্যরাতে অত্যাচার’ ; ‘রাত্রি’ ; ‘জ্যাোস্নার অত্যাচার’ ; ‘বিবস্ত্র চাঁদ’ ; ‘চিত্রিত শহর’]
‘আজ রাতে’ কল্পনার কবিতা। জ্যাোস্না “আজ রাতে চিলে কোঠা থেকে নদী ব’য়ে যাবে স্নানার্থীরা দলে দলে জমা হবে …… অবাধ্য দাগ …… ময়লা …… সে-সব ধোয়া হবে আজ রাতে “।
৩. পুনরাবৃত্তির প্যাটার্নে কবিতা। / [ ‘যদি তুমি আসো’ ; ‘আমার ছাত্র ও তার প্রেমিকার জন্য এলিজি’ ; ‘বৃষ্টি নামে’ ]
‘যদি তুমি আসো’, ‘আমার ছাত্র ও তার প্রেমিকার জন্য এলিজি’ কবিতাগুলো রাহমান, সুনীল-এর ক্রিয়াপদ-বাক্য-বাক্যাংশের আবর্তনের কায়দা দিয়ে রচিত। ষাটের পরে অনেকের কবিতায়ই এই ট্রেন্ড আছে। পরেকার কবিতা গ্রন্থেও এই গঠনের কবিতা আজাদ লিখেছেন। ‘যদি তুমি আসো’ কবিতাটির নামও রাহমান-এর ‘যদি তুমি ফিরে না আসো’-র প্রায় হুবহু। ‘বৃষ্টি নামে’ কবিতাটি চমৎকার। ছোট কিন্তু ‘বৃষ্টি নামে’, এই পুনরাবৃত্তির শেষে – ‘ টের পাই বুকের বাঁ দিকে মাটি ঠেলে উদ্ভিদ উঠছে, আমি তার সরল শেকড়’, ভালো মোচড়।
• লোরকা-র অনুসরণে কবিতা / [ ‘ছাদআরোহীর কবিতা’ ; ‘সেই এক বেহালা-বেহালা’ ]
‘সেই এক বেহালা’ ৩ অংশে একটি প্রেমের কবিতা যার সুর, প্রেমিকা সুখও দিতে পারে বিষাদও দিতে পারে। ২য় অংশ, ‘বেহালা’ ফেদেরিকো লোরকা-র ‘গিটার’ কবিতার আদলে রচিত, বিষয়বস্তুও এক। ‘ছাদআরোহীর কবিতা’-টিতেও লোরকা-র নির্মাণের কিছু ছায়া আছে।
• সমসাময়িক কবিদের ধারণার কবিতা / [ বঙ্গউন্নয়ন ট্রাস্ট ]
রাহমান, লোরকা – এঁদের ব্যবহার করে কবিতার উল্লেখ করেছি। প্রকৃতি বিরোধী কবিতা, ‘বঙ্গউন্নয়ন ট্রাস্ট’ শহীদ কাদরী-র ১৯৭০ এর সাইক্লোনের পরে লেখা ‘একটি ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের জার্নাল’ এবং ‘নিসর্গের নুন’-এর ধাঁচে লেখা। এখানে রোমান্টিক কবিদের প্রকৃতি প্রেমের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ আইডিয়াকে ইশতেহার করার অভিলাষ ও উদ্যাোগ।
• অ্যান্টিপোয়েট্রি । / [ ‘হরস্কোপ’ ]
আজাদ-এর স্বর অ্যান্টিপোয়েট্রির জন্য উপযোগী। তাঁর ভাষা, কথন ধারালো। পরেকার গ্রন্থগুলিতে তিনি আরও অ্যান্টিপোয়েট্রি স্বাদের কবিতা লিখেছেন।
• আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মগৌরব, আত্মপ্রচারের কবিতা। / [‘বিরোধী দল; যাও রিকশা যাও’ ; ‘হুমায়ুন আজাদ’ ]
• ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজের অধঃপতনের ইঙ্গিতের এবং নিজের অপারগতার কবিতা। / [‘সব সাংবাদিক জানেন’ ; ]
আজাদ যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে কবিতাগুলো লিখেছেন। তিরিশের কবিদের অধ্যয়ন, কিছু বিদেশী কবিদের পাঠ, সঙ্গে-সঙ্গে সমকালীন কবিদের কবিতা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল। ছন্দে পাকা, যার উদাহরণ এই ২২ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত :
নাচো, নাচো, হে নর্তকী, এই বক্ষে, এই স্টেজে, নাচো চিরদিন।
বাজাও নুপূর ঘন, আবর্তিত হও, শব্দ তোল উদ্ভিদবিদ্যার,
পায়ের আঘাতে হোক রক্তবীথি ছিন্নভিন্ন, মাংসরা মলিন,
নাচো, নাচো, হে নর্তকী, এই বক্ষ, এই স্টেজ সর্বদা তোমার।
[ স্টেজ / অলৌকিক ইস্টিমার ]
ব্যক্তি, কবিতার শিল্পগত দিক, প্রেম, সমাজ-ঘটনা-সংসর্গ এগুলো সবই এই গ্রন্থের কবিতার বিষয়।
২. দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ জ্বলো চিতাবাঘ । প্রথম গ্রন্থকে ক্রমানুসরণ করেই এখানে এই সব বিষয়, আবহ, টেকনিক :
• প্রেম বিষয়ক কবিতা / [ ‘প্রেম’, ‘তোমার সৌন্দর্য’, ‘এক বছর’, ‘পাপ’]
• কিছু পরাবাস্তব টাইপের কবিতা/ [ ‘সৌন্দর্য’, ‘পোশাকপরিচ্ছদ’, ‘পরাবাস্তব বাংলা’ ]
• পুনরাবৃত্তির প্যাটার্নে কবিতা। / [‘সেও আছে পাশে’ ]
• মাত্রাবৃত্ত, সাত মাত্রার কবিতা / [ ‘মাতাল’, ‘অন্ধ রেলগাড়ি’ ]
• প্রকৃতি-বিরোধ ধারণার কবিতা / [ ‘শত্রুদের মধ্যে’ ]
• অ্যান্টিপোয়েট্রি । / [ ‘বন্যা’ ]
• আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মগৌরব, আত্মপ্রচারের কবিতা। / [ ‘উন্মাদ ও অন্ধরা’, ‘সবুজ জলোচ্ছ্বাস’ ]
• ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজের অধঃপতনের ইঙ্গিতের এবং নিজের অপারগতার কবিতা। / [ ‘বন্যা’, ‘স্বরাষ্ট্র’ ]
৩. তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে
• স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের জীবনের মধ্যে দিয়ে সামাজিক সমস্যা, অনিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ সংকট। / [ ‘জল দাও বাতাস –জননী’,’আমার সন্তান’, ‘আমার কন্যার জন্য প্রার্থনা’ ]
• কিছু পরাবাস্তব ধরণের কবিতা / [ ‘নৌকো অধরা সুন্দর’ ]
‘নৌকো অধরা সুন্দর’, একটি চমৎকার কল্পনার কবিতা। “একটি রংচটা শালিখের পিছে ছুটে ছুটে দিক পার হয়ে ছাড়াবাড়িটার কামরাঙা গাছটির দিকে যেই পা বাড়িয়েছি, দেখি – নৌকো – ভেসে আসে অনন্ত দু-ভাগ ক’রে। পাল নেই মাঝি নেই, শুধু ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে আসে ধ্রুবতারা আমারই দিকে। “ কবিতাটি ‘সোনার তরী’ এবং ‘মাতাল তরণী’ দিয়ে উদ্দীপিত কিন্তু কল্পনা, শব্দ, চিত্রকল্পে এবং বাচনশৈলী আজাদ-এর। একটি নির্মাণের কবিতা যা উপভোগ করা যায়।
• পুনরাবৃত্তির প্যাটার্নে কবিতা। / [ ‘আমাকে ভালোবাসবার পর’, ‘তোমার পায়ের নিচে’, ‘যতোবার জন্ম নিই’ ]
• অ্যান্টিপোয়েট্রি । / [ ‘পৃথিবীতে একটিও বন্দুক থাকবে না’, ‘আমি কি ছুঁয়ে ফেলবো’ ]
• প্রেমের কবিতা / [‘আমাকে ভালোবাসবার পর’ ]
• আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মগৌরব, আত্মপ্রচারের কবিতা। / [ ‘খাপ-না-খাওয়া মানুষ’ ]
• ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজের অধঃপতনের ইঙ্গিতের এবং নিজের অপারগতার কবিতা। / [ ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, ‘পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে’, ‘তোমার পায়ের নিচে’ ]
এই গ্রন্থে লম্বা মাত্রার অক্ষরবৃত্তের কবিতা, বেশ কিছু ব্যাঙ্গাত্মক অ্যান্টিপোয়েট্রি, আত্মগৌরবের কবিতা থাকা সত্বেও ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ কবিতাটির গুরুত্ব আছে। এই কবিতায় শ্লোগানসুলভ চড়া বক্তব্য আছে। তবুও এর মধ্যে একটা সময়ের চিহ্ন আছে। আজাদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক অবনতিকে ধরতে পেরেছেন। শিল্পসম্মতভাবে এইসব বিষয়ের কবিতার একটা সীমা আছে। তবু আজাদ-এর ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, এই অবলোকন ২০১৬ সনে এসেও তথ্যর সাক্ষীদার।
• বিদ্রূপের কবিতা / [ ‘তুমি সোনা আর গাধা করো’, ‘নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু’, ‘আশির দশকের মানুষেরা’, ‘যতোবার জন্ম নিই’, ‘কবির লাশ’ ]
৪. / ৫. চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপারে যাই নীল’ এবং পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ এরশাদ-এর সামরিক শাসনের আমলে লেখা। এর কবিতাগুলো বেশির ভাগ বক্রোক্তির অ্যান্টিপোয়েট্রি। অনেকগুলোই শ্লোগান এবং আমি-সর্বস্ব ; পুনরাবৃত্তি নির্ভর [ ‘গরিবদের সৌন্দর্য’ , ‘সামরিক আইন ভাঙার পাঁচ রকম পদ্ধতি’ /‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপারে যাই নীল’ ; ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’, ‘হ্যামেলনের বাঁশিঅলার প্রতি আবেদন’, ‘ঢাকায় ঢুকতে যা যা তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে’ / ‘ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ এরশাদ ] । মানতে হবে, সেই সময়ের একটা ছবি পাওয়া যায় – সমাজ-রাজনীতির, সঙ্গে-সঙ্গে তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের আত্মক্ষয় ও প্রতিভাহীনতার এবং কিছুটা আত্মভরিতার [ ‘গরু ও গাধা’, ‘যা কিছু আমি ভালোবাসি’, ‘কবি ও জনস্তাবকতা’ /‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’ ; ‘পার্টিতে’ / ‘ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ এরশাদ ]। বরং ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’ –এর দুটো কবিতা, ‘যদি ওর মতো আমারও সব কিছু ভালো লাগতো’, “ও ঘুমোয় আমি জেগে থাকি’ কন্যার মধ্যে দিয়ে নিজের অস্বস্তি, অপারগতা, সামাজিক পতন-এর চিত্রণ সুখপাঠ্য। ‘পর্বত’/‘ আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ , একটি কবিতা যেখানে আজাদ স্মৃতি এবং বর্তমান চিত্রণে আত্মবিশ্বাস এবং কবিতার শিল্পর চমৎকার সহাবস্থান ঘটিয়েছেন।
আটবছর বয়সে আমার খুব ভালো লেগেছিলো ডালিমের ডালে
ঘুমের মতন ব’সে থাকা দোয়েলটিকে।
তারপর অসংখ্য দুপুরে আমি ঘুম হ’য়ে ডালিমের শাখায় এসেছি।
—-
আমি বেড়ে উঠেছি অবিচল পর্বতের মতো, যখন আমার
পাদদেশে পশুদের কোলাহল, তখন আমার গ্রীবা ঘিরে মেঘ,
বুক জুড়ে বৃষ্টি, আর চুড়োর ওপর ঘন গাঢ নীল।
[ পর্বত / আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে ]
৬. কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ। ‘রাজনীতিবিদগণ’, রাজনীতির অবক্ষয়ের সময়ের রাগী কবিতা। দেশ ও দশের সর্ববিধ ক্ষতির এজেন্ট এই দল । চিত্রকল্প এবং বাচনের পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে আজাদ এঁদের রূপ প্রকাশ করেন। “ যখন তাদের দেখি অন্ধ হয়ে আসে দুই চোখ। ভয় পাই কোনো দিন দেখতে পাবো না হায় মেঘ পাতা সবুজ শিশির …… আর্তনাদ করে বাঁশি যখন ওঠেন মঞ্চে রাজনীতিবিদ্গণ।“ এগুলো কাব্য হিশেবে প্রাচারধর্মী হতে বাধ্য। তবু, সময়ের চিহ্ন মানতেই হবে। পরিবারবর্গের মধ্যে দিয়ে ৩টি কবিতায় বোধকে দৃপ্ত-দুঃখে প্রকাশ করেছেন আজাদ। ‘পিতার সমাধিলিপি’-তে তৃতীয় বিশ্বে জন্মে প্রতিকূলতায় অবিকশিত হবার ব্যর্থতা সমাধিফলকে উৎকীর্ণ করেছেন। ‘আমার পাঁচ বছরের মেয়ের ব্যর্থতায়’ একটি রূঢ় বোধের কবিতা, শিশু মেয়ের প্রথম ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে প্রকটিত। ব্যর্থতা, অসফলতা আমাদের জীবনের সহচর। আমরা বয়সের সঙ্গে তা বুঝি এবং ঝুঝতে শিখি। কিন্তু পাঁচ বছরের মেয়ের ব্যর্থতা এই প্রথম, যে “ নীলপদ্ম, রাজহাঁস, – সভ্যতার সাফল্য। …… পাঁচ বছর বয়সেই তোমাকে পৃথিবী মন্ত্রণা দিচ্ছে নিজ হাতে নিতে নিজ ভার, – নিজ হাতে তুমি তুলে নিয়েছিলে তোমার পৃথিবী, কিন্তু তুমি ব্যর্থ হয়েছো ; – ওরা তোমাকে ব্যর্থ ব’লে ঘোষণা করেছে ; – আর তুমি হঠাত উঠেছো হয়ে পৃথিবীর সমান বয়সী, পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা জমেছে তোমার এক টুকরো বুকে। …… ব্যর্থতায় – তুমি ভুলবে না ব্যর্থতাই সুন্দরের অন্য নাম। “ কবিতাটি শক্তিশালী এবং নিজস্ব বিশ্লেষণের দাবীদার। তেমনি, ‘আমাদের মা’ , বাঙালি মা বিষয়ের একটি শ্রেষ্ঠ চিত্রণ। মা বিষয়ে বাঙালিরা সততই কাতর এবং সেন্টিমেন্টাল। বুদ্ধদেব বসু-র ‘সন্ধিলগ্ন’ অসাধারণ কবিতা – স্মৃতি, শিল্প, সৃজন, জীবন সব কিছু নিংড়ে, আবেগ প্রহত করে, দূরত্ব-ও-নিকটতা নিমগ্ন ভাষায় পেশি-মর্মবহুল কবিতা এটি। প্রীতি-ভক্তিতে নেতিয়ে পড়া নয়। প্রবীণ-দক্ষ শিল্পীর হাতেই সম্ভব। শামসুর রাহমান ( ‘ কখনো আমার মাকে’ ) এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ-র ( ‘মাগো ওরা বলে’, ‘মা তুমি’ ) একই বিষয়ের কবিতা ভেজামাটির আবেগ-দরদে থরোথরো। আল মাহমুদ-এর ( ‘ফেরার পিপাসা’ ) কবিতাটিতে রুঢ় মাটির প্রলেপ আছে। এ-সবের মধ্যে আজাদ-এর ‘আমাদের মা’-র বৈশিষ্ট্য মানতে হবে। বাঙালি মা যে সাংসারিক ক্ষমতায় গরিব প্রজা অথচ সন্তানদের জন্য সব সময়ই আকুল, এই কথাটিকে চমৎকার সব চিত্রকল্পের মধ্যে দিয়ে সন্তানের বয়ঃক্রম বিকাশের মধ্যে বুনে তুলেছেন নির্মোহ এবং আবেগের ভারসাম্যতার ওপরে। আশলে কবিতাটি পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া কিছু ছোট বিষাদের কবিতা আছে, ‘ভাঙন’, ‘নিরাময়’, ‘প্রেম’, ‘আমি কি পৌঁছে গেছি’, ‘অশ্রুবিন্দু’। যেহেতু আবেগে টলোমলো, ‘আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে ‘ মারা যাবো ছোট্ট ঘাস্ফুলের জন্য …… কবিতাটি আবৃত্তিকারদের জনপ্রিয়। দুটি কবিতা উল্লেখযোগ্য, ‘সেই সব কবিরা কোথায়’ – যেখানে প্রাগাধুনিক-কবিতা-কালের সরল অথচ সৎ বোধের কবিদের স্মরণ করেছেন ; ‘আমরা যখন বুঝে উঠলাম’ – যেখানে ভালোবাসার থেকে না-ভালোবাসার হৈমন্তিক পাতা-ঝরার প্রহর । আজাদ-এর নিজস্ব চলনের কবিতা, ‘সামান্য মানুষ’। এই কবিতাটিতে রাগী, আত্মম্ভরী, বক্রোক্তিকার আজাদ সম্ভাবনার সীমার মধ্যে নিজের অপারগতা উপলব্ধি করেছেন। “ কী ক’রে অসামান্য হবো ? চারপাশে যদি সব ক্ষুদ্র হয়, তুচ্ছ হয় খুব, তাহলে কী ক’রে অসামান্য হতে পারি আমি ? …… শুনতে পাই দূরে মাঝেমাঝে ঘটছে অসামান্য কতো কিছু ; কিন্তু আমি ধানের গুচ্ছের চেয়ে মহৎ কিছু দেখি নি। …… কী ক’রে অসামান্য হবো ? অত্যন্ত সামান্য মানুষের অধীনে করেছি বাস, অতো তুচ্ছ সামান্যদের অধীনে থেকে কেউ কি কখনো হয়ে উঠতে পারে অসামান্য? বদ্ধ ঘরে বাড়তে পারে শালতাল ?” এই খানে কবিতা সৎ এবং সংবেদনশীল।
উপরের আলোচনার কাঠামো এবং আধারের ভিত্তিতে আমরা সারকথা আরেকবার নির্বাচিত করবো।
1. হুমায়ুন আজাদ প্রস্তুতি নিয়ে কবিতা লিখতে বসেছিলেন। বাংলা কবিতার সকল অধ্যায়, ষাটের সমকালীন কবিতাসহ তাঁর জানা। আন্তর্জাতিক কবিতাও তাঁর পরিচিত ছিল সীমার মধ্যে। তিরিশের কবিদের কবিতাশৈলী আজাদ পরিচর্যা করেছিলেন – এটা বোঝা যায়, যদিও তাঁদের জাতের কবিতা-সংখ্যা সামান্যই।
2. তাঁর কাব্যভাষা পঞ্চাশ থেকে বাংলাদেশের এবং তিরিশের কবিদের ভাষা থেকেই সঞ্জাত। তাঁর নিজস্ব চলন নজরে আসে যখন তিনি অ্যান্টিপোয়েট্রি লেখেন। কবিতাকে যে চিত্রকল্পের মধ্যে দিয়ে বলতে হবে, উত্তর-রোমান্টিক কবিতার এই সবক তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন।
3. হুমায়ুন আজাদ-এর হাত ছন্দে পাকা। অক্ষরবৃত্তে বেশি লিখেছেন, দুটি সাত মাত্রার কবিতা আছে। পড়লেই বোঝা যায়, অক্ষরবৃত্তে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং বুদ্ধদেব বসুর কাছে তাঁর নীরব-নিয়ত শিক্ষা রয়েছে যদিও সুধীন্দ্রীয় শব্দ ব্যবহার করেন নি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, অলৌকিক ইস্টিমার-এ দুটি কবিতাংশে এবং পাঁচটি কবিতায় অক্ষরবৃত্ত। নিচের উদ্ধৃতির মাত্রাগঠন এবং কবিতার লয়ের বিস্তার আজাদ-এর দক্ষতা স্পষ্ট করে দ্যায়।
কখনো শোনাই গান নিজকন্ঠে, কখনোবা গ্রামোফোন খুলে,
কবিতা শোনাই তারে; নবীদের বিবিদের পুণ্য উপকথা;
শাসাবের কাছ থেকে মেগে আনা তাবিজটা বেঁধে দিই চুলে,
আতর লেবান সেন্টে আমোদিত সারাগৃহ সর্বত্র সততা।
[ জল দাও, বাতাস/ অলৌকিক ইস্টিমার ]
এর পরও তিনি কিছুটা মোলায়েম অক্ষরবৃত্ত লিখেছেন, যেমন ‘পাপ’, ‘এই তো ছিলাম শিশু’, ‘পিতার সমাধিলিপি’। সাত মাত্রার কবিতা ‘অন্ধ রেলগাড়ি’, “বধির রেলগাড়ি অন্ধ রেল বেয়ে চলছে দ্রুত বেগে / দু-চোখ মরা ঘুম আকাশে মরা মেঘ সঙ্গে মরা চাঁদ অন্ধ আছি জেগে “, এবং অন্যটি ‘মাতাল’
মাতাল হয়ে আছি করছি শুধু পান
সুদূরে নিকটে যা-কিছু চলছে, জ্বলছে;
স্তব্ধ বাতিঘর, নদীতে নীল শব;
হংসসারিকা এবং ভিতর টলছে।
চোলাই করি চোখে গোপন ঘরে বসে
দৃশ্যসুরের মজ্জার থেকে মদ্য,
পুলিশ থেকে দূরে গাছের অতি কাছে
যেনো ধরণীতে ছিলো না কখনো গদ্য।
[ মাতাল / জ্বলো চিতাবাঘ ]
এখানে আমার কানে মাত্রা ঠিক মেলে না। মাত্রাবৃত্তের ‘সবুজ সাবমেরিন’ কবিতাও ছন্দে টলোমলো। এর বাইরে, মাত্রাবৃত্ত শুধু কিশোরদের জন্য কবিতায় লিখেছেন। গদ্য-কবিতায় আজাদ সিদ্ধহস্ত।
4. তাঁর কবিতায় সময়ের চিহ্ন আছে। সমাজ-রাজনীতির, রাজনীতিবিদদের বিষয়ের কবিতা রাগী। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, এই সব বিষয় কবিতার “শব বাহনের” কাজ। শ্লোগানের টোন থাকলেও, ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ ২০১৬ সনেও সমাজ ও সময়ের স্বাক্ষর ধারণ করে আছে।
5. তিনি বেশ কিছু শাণিত ভাষার বক্রোক্তির ‘অ্যান্টিপয়েট্রি’ রচনা করেছেন – রাজনীতি, সমাজ, প্রেম, শিল্পের উন্নাসিকতা বিষয়ে।
6. আজাদ-এর মধ্যে, ‘আমি সিংহ, তোমরা গাধা’, এই জাতীয় একটা বোধ কখনো কখনো উগ্র বা প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে।
7. সমসাময়িকদের মধ্যে থেকে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর কাজের পরোক্ষ ছাপ দ্যাখা যায় আজাদ-এর কিছু কবিতায়। এটা স্বাভাবিক।
8. আমার বিচারে, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-বাবা-মা-র মধ্যে দিয়ে সমাজের সংকট-অবক্ষয়ের যে-সব কবিতা আজাদ লিখেছেন সে-গুলো ইউনিক। কিছু কবিতায় তিনি নিজের অপারগতা এবং সীমাবদ্ধতার কবিতাও লিখেছেন, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চাশের পরের বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ তাঁর নিজের স্থান অধিকার করে রেখেছেন।
গ্রন্থপঞ্জী :
হুমায়ুন আজাদ, কাব্যসংগ্রহ, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮
Leave a Reply