শুধু শুধু সিজার

গত ১০ই আগস্ট সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু খাদিজার জন্ম হয় মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। আত্মীয়স্বজনের ইচ্ছা ছিল স্বাভাবিক প্রসবের। কিন্তু চিকিৎসক ও ক্লিনিকের দালালদের প্ররোচনায় মা সালমা বেগম শেষ পর্যন্ত সিজার করতে বাধ্য হলেন। এটি তার প্রথম সন্তান। তার স্বামী থাকেন সৌদিতে। শিশুর মামা আলাপকালে জানান, তাদের ইচ্ছা ছিল বোনের বাচ্চা যেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়। কিন্তু তা হলো না চিকিৎসক ও ক্লিনিকের কর্মচারীদের কারণে। সিজার করতে গিয়ে এই পর্যন্ত তাদের সবমিলে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শিশুটির অবস্থা তেমন ভালো নয়। শিশুটিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ নম্বর কেবিনে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ২০১৫ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর। বিকাল ৩টা। ভোলার সদরের বেসরকারি ক্লিনিক এশিয়াতে কন্যা সন্তান জন্ম দেন জেসমিন বেগম। এটি তার তৃতীয় সন্তান।

ক্লিনিকের চিকিৎসক ডা. আফরোজা এই নারীকে বারবার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের কথা বলেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। কিন্তু স্কুল শিক্ষিকা জেসমিন মনের দিক থেকে অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। ফলে সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু প্রসবে তিনি নেতিবাচক মনোভাব দেখান। স্বাভাবিকভাবে প্রসবে মত দেন তিনি ও তার স্বজনরা। এই দম্পতির অন্য বাচ্চারাও স্বাভাবিকভাবে হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। শুধু সালমা বা জেসমিনের সন্তানই নয়, দেশে সিজারিয়ানের সংখ্যা বাড়ছেই। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। গত বছর দেশে ৮ লাখ ২০ হাজার ৫১২ শিশুর জন্ম অস্ত্রোপচারে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছে, সিজারিয়ান সেকশন এখন দেশের বেশির ভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রোধ তো করা যাচ্ছেই না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোনো প্রসূতি পেলেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর এক শ্রেণির চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয় অনেক ক্ষেত্রে। নিরুপায় হয়ে প্রসূতি ও তার স্বজনরা নিরাপদ মাতৃত্ব ও সুস্থ সন্তানের স্বার্থে হাসপাতালের প্রত্যাশায় সায় দেয়। আর সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রসব পদ্ধতিতে রাজি হলেই শুরু হয় টাকা হাতানোর হিসাব কষাকষি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিক প্রসবের খরচ সর্বোচ্চ তিন হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা এবং অস্ত্রোপচারে খরচ সর্বনিম্ন ১৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এর বাইরে কেবিন ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। সরকারি জেলা হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের সময় রোগীর পক্ষকে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ওষুধ কিনলেই চলে, আর অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কিনতে হয় কমপক্ষে তিন হাজার টাকার ওষুধ।

দেশে অনেক নারীর নিজ ও পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছায়, কেউবা চিকিৎসকের কথায় বিশ্বাস করে বা প্ররোচণায় পড়ে সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু প্রসব করছেন। সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্ম বাড়ছে। এতে শীর্ষে রয়েছেন শিক্ষিত ধনী শ্রেণির যুবতীরা। ‘মাতৃমৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা জরিপ ২০১০’ চিত্রে দেখা যায়, ২০০৯ সালেদেশে চার লাখের বেশি শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল। ২০০১ সালের তুলনায় এই সংখ্যা পাঁচ থেকে ৬ গুণ বেশি। দেশে শিশু জন্মের সংখ্যা ও হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারও বেশি হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে সেবা গ্রহণকারী পক্ষকে বিপুল অর্থ অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার দরকার হয়। মায়ের অপুষ্টি ও গর্ভকালীন সমস্যার কারণে প্রসবে জটিলতা দেখা দেয়। মা ও নবজাতকের প্রাণ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সিজারিয়ানে শিশু জন্ম বাড়ছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-২০১৪-এর তথ্য মতে, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের বাড়ার গতি ২০০৪ সালে ছিল ৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে ছিল ৯ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ১৫ শতাংশ আর ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশ। এতে ৮ শতাংশ অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষিত ও ধনিক শ্রেণির মধ্যে অস্ত্রোপচারের হার বেশি। দরিদ্র পরিবারে ৭ শতাংশ সিজারিয়ান করান। সরকারি হাসপাতালে ৩৪ শতাংশ, ৮০ শতাংশ লাভজনক প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে, ২৪ শতাংশ এনজিও প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমের শিশু জন্ম দিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টারা জানান, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে বাচ্চা প্রসব করলে হাসপাতালের আয় হয় অতিরিক্ত টাকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়ী মনোভাব আর ডাক্তারদের যথেষ্ট সময় না দেয়াই এর অন্যতম কারণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্র জানান, গেল বছর এইখানে নতুন শিশুর জন্ম হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ হাজার। এর মধ্যে সিজারিয়ান হয়েছে ৫০ শতাংশ নারীর। এ প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. ফেরদোসৗ ইসলাম বলেন, সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু জন্ম প্রসবের প্রবণতা বাড়ছে। এটা শিক্ষিত নারীদের মধ্যে বেশি। তার হাসপাতালে বছরে যত শিশু জন্ম হয়, তার মধ্যে ৫০ শতাংশই হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। মায়েরা ব্যথা সহ্য করতে চান না। নতুনদের মধ্যে প্রবণতা বেশি। চিকিৎসকরাও অনেক সময় ঝুঁকি নিতে চান না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন এবং গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাভাবিক প্রসবের ভয় থাকে অনেক মায়ের। অনেক মা প্রসবযন্ত্রণা পেতে চান না। অনেক মা মনে করেন, স্বাভাবিক প্রসবে তার যৌনাঙ্গের ক্ষতি হবে। এসব মা অস্ত্রোপচারে আগ্রহ দেখান। তারা বলেন, উচ্চহারে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের সঙ্গে অপরিণত শিশু জন্মের সম্পর্ক আছে, এতে শিশুর প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বেশি। একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেছেন, দুটি সন্তান জন্ম দেয়ার পর অন্য কোনো কারণে মায়ের পেটে অস্ত্রোপচার দরকার হলে ঝুঁকি বাড়ে। তারা বলেন, নিশ্চিত কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ (অ্যাবসলিউট ইন্ডিকেটর) আছে, যা দেখে বলা যায় অস্ত্রোপচার লাগবে। কিছু ক্ষেত্রে (যেমন জোড়া শিশু) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবের সময়ে হঠাৎ কোনো বিপর্যয় এড়াতে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে অস্ত্রোপচার দরকার হয়ে পড়ে। যে কারণেই অস্ত্রোপচার করা হোক না কেন, চিকিৎসককে তা ব্যবস্থাপত্রে লিখতে হবে। চিকিৎসককে যদি জবাবদিহি করতে হয়, তাহলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার কমে যাবে।

চলতি বছরের ২রা মার্চ জাতীয় সংসদে লিখিত প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, দেশে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে তুলনামূলকভাবে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার অনেক বেশি। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে-২০১১ অনুসারে সিজারিয়ান অপারেশনের হার ছিল শতকরা ১৫ ভাগ। ২০১৪ সালে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার শতকরা ২৩ ভাগে উন্নীত হয়। সে হিসাবে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে দেশে সিজিরিয়ান অপারেশনের হার শতকরা ৮ ভাগ বেড়েছে বলে জানান তিনি। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে তুলনামূলক সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার অনেক বেশি জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারি হাসপাতালে প্রসবসেবা বাড়ানোর মাধ্যমে বেসরকারি হাসাপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের হার কমানোর লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন সর্বশেষ নতুন বিশ্লেষণে বলেছে, বাংলাদেশে সন্তান জন্মে অস্ত্রোপচারের ৭০ শতাংশই অপ্রয়োজীয়। গত বছর এমন অস্ত্রোপচারের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৮৭২। বছরে সিজারিয়ানে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে প্রয়োজনের সময় অনেক দরিদ্র পরিবারের নারী এই জীবন রক্ষাকারী সেবা পাচ্ছেন না। ২০০৪ সালে সন্তান প্রসবে অস্ত্রোপচার ছিল ৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে তা বেড়ে ২৩ শতাংশে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞদের বরাতে সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে ৩০ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। সংস্থাটির হিসাব মতে, ২০১৬ সালে দেশে ৩৫ লাখ ৫২ হাজার শিশুর জন্ম হয়। সংস্থাটি বলছে, গত বছর দেশে ৮ লাখ ২০ হাজার ৫১২টি শিশুর জন্ম অস্ত্রোপচারে হয়েছে। সংস্থাটির বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং নবজাতক ও মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক মান্নান এ পরিস্থিতিকে গভীর উদ্বেগের উল্লেখ করে বলেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের বিবেচনায় প্রয়োজন নেই এমন ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা হলে মা ও নবজাতক দুজনই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে।

এতে প্রসব পরবর্তী সংক্রমণ বাড়ে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, অঙ্গহানি ঘটে। প্রসূতির সুস্থ হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগে। সংস্থাটি বলছে, অস্ত্রোপচারে রোগীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ করতে হয়। হাসপাতালে অবস্থানের সময় ধরা হয়েছে সাত দিন। প্রত্যক্ষ খরচের মধ্যে আছে ওষুধ, চিকিৎসক, হাসপাতালে থাকা, খাবার, হাসপাতালে যাওয়া-আসা। পরোক্ষ খরচের মধ্যে ধরা হয়েছে উপার্জনে ক্ষতি (এই বয়সী নারীদের বড় অংশ উপার্জনক্ষম), স্বামীর উপার্জনে ক্ষতি এবং পরিবারের অন্যদের উপার্জনে ক্ষতি। এ ছাড়া ২৫ শতাংশ রোগীকে অস্ত্রোপচার পরবর্তী জটিলতায় ভুগতে হয়, এর কারণে বাড়তি খরচ হয় (১২ দিন ধরা হয়েছে)। এদের ওষুধ, চিকিৎসক, হাসপাতালে থাকা, খাবার এবং আত্মীয়দের হাসপাতালে যাওয়া-আসার জন্য বাড়তি খরচ হয়। সবমিলে একটি অস্ত্রোপচারে গড়ে ৫৫২ মার্কিন ডলার বা ৪৪ হাজার ১৬০ টাকা ব্যয় হয় (উপার্জনের ক্ষতিসহ)।

মানবজমিন
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.