জাপানে ক্রীড়া উৎসব

হাসিনা বেগম রেখা: ক্রীড়ামোদী জাপানিদের কথা আমাদের অনেকেরই জানা আছে। বিশ্ব ক্রীড়া আসরে তাদের প্রাধান্য যেমন আছে তেমনি বিশ্ব আসরের সফল আয়োজনেও তাদের জুড়ি মেলা ভার। দেশটি ১৯৬৮ সালে অলিম্পিক আয়োজন করে সাফল্য পেয়েছে। ২০০২ সালে কোরিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করেছে। আগামী ২০১৯ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপ রাগবি। এ ছাড়া ২০২০ সালে টোকিও অলিম্পিক ও প্যারা অলিম্পিক।

শিশুকাল থেকেই জাপানিদের ক্রীড়াপ্রেমী করে গড়ে তোলা হয়। প্রথমে একটি শিশুটি তার মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানির হাত ধরে এলাকাভিত্তিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। প্রত্যেক শিশুকেই উপহার দেওয়াটা এখানকার রীতি।

এখানে রয়েছে ক্রীড়া দিবস পালন করার জন্য সরকারি ছুটি। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সোমবার সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। আগে ছিল অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ। জাপানি ভাষায় দিবসটিকে বলা হয় ‘তাইকু নো হি’। বাংলায় যাকে বলা যায় ক্রীড়া বা শরীরচর্চা দিবস।

আসলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা না বলে ক্রীড়া উৎসবই বলা ভালো। কারণ, এখানে কিন্ডারগার্টেন, প্রাইমারি স্কুল, জুনিয়র হাইস্কুল, সিনিয়র হাইস্কুল কিংবা এলাকাভিত্তিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নামে যে সব আয়োজন করা হয় তাতে যতটা না প্রতিযোগিতা থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষক, কর্মচারী ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এতে অংশ নেন।

প্রাইমারি স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা মানে রীতিমতো উৎসব। অভিভাবকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এবং এর পরদিন স্কুল ছুটি থাকে।

আমরা টোকিওর কিতা সিটির যে এলাকায় থাকি তার নাম হচ্ছে কিরিগাওকা। কিতা সিটির মোট জনসংখ্যা ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৭ জন (১ আগস্ট ২০১৭ অনুযায়ী)। তার মধ্যে প্রায় ১২ হাজার লোকের বাস কিরিগাওকাতে। বাঙালি পরিবারের বসবাসও কম নয় এই এলাকাতে। সব মিলিয়ে ২০টির মতো বাঙালি পরিবারের বসবাস এই এলাকাতে।

প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এখানে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়। এ বছর ১৫ অক্টোবর ছিল ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নির্দিষ্ট দিন। বৈরী আবহাওয়ার কারণে এ বছর আয়োজনটি খোলা মাঠে করা সম্ভব হয়নি। তাই স্থানীয় কিরিগাওকা জুনিয়র হাইস্কুলের অডিটোরিয়ামে এর আয়োজন করা হয়। ইনডোরে করা হলেও উৎসাহের কোনো কমতি ছিল না।

সকাল নয়টায় শুরু হওয়ার নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকলেও কিতা সিটি মেয়র হানাগাওয়া ইয়সোতা তার আগেই উপস্থিত হয়ে এলাকার জনগণের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে থাকেন। তার একটু পরেই স্থানীয় সংসদ সদস্য আকিহিরো অতা উপস্থিত হয়ে কুশল বিনিময় শুরু করেন।

এখানকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছান কোনো দ্বিধা ছাড়াই। কারণ, তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণই তাদের আস্থার কেন্দ্র। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রায়ই দেখা যায় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে রেলস্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে জনগণের কল্যাণ কামনা করে নিজের বক্তব্য জানান দেওয়া। এই বক্তব্য দাঁড়িয়ে কেউ শুনছেন এমনটি না দেখা গেলেও তাদের চেষ্টার কমতি থাকে না।

ক্রীড়ার বিভাগগুলোও বেশ মজার। সব বয়সীদের জন্য উপযুক্ত। সবাই তাতে অংশও নিয়ে থাকেন। উপহারগুলোও ব্যতিক্রম ধর্মী। সবই গৃহস্থালি কাজের উপযুক্ত। এখানে উপহার মানে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আকিহিরো অতা অংশ নিয়ে পেয়েছেন ৪টি গোল আলু। এতেই তিনি খুশি। আরেকজন প্রতিনিধি আকিরা কামিকাওয়া (ওয়ার্ড কমিশনার) পেয়েছেন একটি টুল বক্স। এভাবে পেঁয়াজ, গাজর, আলু, ঝুরি, বক্স, টিস্যু, ন্যাপকিন, বাকেট, ময়লা রাখার পাত্র, প্যাকেট জাতীয় খাবার, বসার জন্য পিঁড়ি বা এই জাতীয় উপহার দেওয়া হয়ে থাকে।

খেলা শুরু হওয়ার আগে এবং সব শেষে মিউজিকের সঙ্গে শরীরচর্চায় অংশ নিতে হয়। এতে সবাই অংশ নেন। এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন এলাকাভিত্তিক আয়োজনে।

দেওয়া হয় দুপুরের খাবার। তবে এই খাবার পেতে হলে আগ থেকেই জানিয়ে দিতে হয় যে তিনি অংশ নিচ্ছেন। খাবার বিতরণের সময় কিছুটা অনিয়মও দেখা যায়। বিদেশি বিশেষত বাংলাদেশিরাই এই সব অনিয়ম বেশি করেন। নাম দিয়ে রাখেন, খেলায় অংশও নেন না, কেবলমাত্র খাবার বিতরণের সময় গিয়ে লাইন ধরেন। এসব নিয়ে কানাঘুষা হয়। কোনো বাংলাদেশিকে নিয়ে এ ব্যাপারে কানাঘুষা হলে আত্মসম্মানে লাগে। জাপানে আমার বসবাস আড়াই বছর (৯ জুন ২০১৫ থেকে)। আমি এই উৎসবে মোট তিনবার অংশ নিয়েছি। প্রতিবারই একই ঘটনার পুনরাবৃতি ঘটেছে আমার সামনেই। স্থানীয় বয়স্কদের সমালোচনায় মাথা নিচু হয়েছে। কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই নিজ দেশীয়দের নিয়ে সমালোচনা হজম করা ছাড়া।

প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.