১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করে বিজয় অর্জন করায় ভাষার জন্য আমরা গর্ববোধ করি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু সারাবিশ্বে আমরা যে গৌরব অর্জন করেছি তা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব হলেও বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানান মুন্সিগঞ্জে অনুসরণ করা হচ্ছেনা।
মুন্সিগঞ্জের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে একই বানান নানানভাবে লেখা হচ্ছে। বানানে অসঙ্গতি থাকায় বিড়ম্বনায় পড়ছেন মুন্সিগঞ্জ জেলার বাসিন্দারা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বাংলা একাডেমির অভিন্ন ও শুদ্ধ বাংলা বানান অনুসরণ করে পাঠ্যবই প্রণয়ন করছে। এছাড়া, সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও ‘সরকারি কাজে বাংলা’ পুস্তক আকারে প্রকাশ করে সরকারি পর্যায়ে তা অনুসরণ করার জন্য নির্দেশনা জারি করে। কিন্তু মুন্সিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানের নাম লেখা হচ্ছে কয়েকভাবে। এর মধ্যে খোদ মুন্সিগঞ্জ জেলা ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নামই লেখা আছে নানাভাবে। মুন্সিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরেও জেনে না জেনে চলছে এ ভুল বানানের চর্চা।
এদিকে, জেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামফলকে এখনও ‘সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ বানানটি এভাবে লেখা রয়েছে। নামফলকসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বাংলা বানানে রয়েছে অসংখ্য অশুদ্ধ বানান। একই বানানে কখনও হ্রস্ব ই-কার (‘ ি’) আবার কখনও দীর্ঘ ঈ-কার (‘ী’) ব্যবহার হচ্ছে। বিদেশি শব্দ ‘ফেব্রুয়ারি’ বানানটি শুদ্ধ হলেও অনেক ক্ষেত্রে অশুদ্ধ আকারে এটা ‘ফেব্রুয়ারী’ লেখা হচ্ছে। প্রমিত বানানরীতি অনুসারে ‘শহিদ’ লেখার কথা থাকলেও সর্বত্র ‘শহীদ’ লেখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এছাড়া, সহযোগিতা, পল্লি, কর্মসূচি, সূচি, কোতয়ালি, পদবি, মামি, নানি, গাড়ি, ইসলামি, শহিদ মিনার, শুমারি, হাজি, জঙ্গি, জঙ্গিবাদ, দামি শব্দগুলোও ভুল বানানে লিখতে দেখা যায়।
এদিকে, বানানরীতি পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে বেশ কিছু স্থানের নামের বানানেও ইদানিং পরিবর্তন দেখা করা যাচ্ছে। নোয়াখালী জেলার বানান ‘ী’ দিয়ে লেখা হয়ে এলেও পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘নোয়াখালি’ লেখা হয়েছে। আবার তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘মীরপুর’ লেখা হলেও পঞ্চম শ্রেণিতে লেখা হয়েছে ‘মিরপুর’। মুন্সিগঞ্জ জেলার নামই লেখা হচ্ছে পাঁচভাবে।
বর্তমানে এ জেলার নাম সরকারিভাবে ‘মুন্সিগঞ্জ এবং মুন্সীগঞ্জ’ এই দুইভাবে লেখা হচ্ছে। এর মধ্যে ‘মুন্সীগঞ্জ’ অধিক হারে লেখা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ মুন্সীগন্জ, মুনশিগনজ, মুন্শীগঞ্জ’ লেখছেন। রামপাল কলেজের বিভিন্ন নামফলকেই ‘মুন্সিগঞ্জ’ বানানটি আছে তিনভাবে। যার একটিও শুদ্ধ নয়। কলেজটির দাতাগণের বিভিন্ন নামেও রয়েছে ভুল বানানের ছড়াছড়ি। প্রমিত বাংলা বানান অনুযায়ী ‘মুন্সিগঞ্জ’ বানানটি শুদ্ধ।
এদিকে, জেলার একটি উপজেলার নাম ‘টঙ্গীবাড়ী, টংগীবাড়ী, টংগিবাড়ী এবং টুঙ্গীবাড়ী’ রয়েছে চার রকম বানানে, প্রমিত বাংলা বানানে যার একটিও শুদ্ধ নয়। প্রমিত বাংলা বানানে ‘টঙ্গিবাড়ী’ উপজেলার নামটি রয়েছে এভাবে। এরমধ্যে টঙ্গিবাড়ী থানা ভবনে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নামটি লেখা রয়েছে দু’রকম বানানে।
এছাড়া, বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামের নামও লেখা হচ্ছে নানাভাবে। এদিকে, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সব প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষায় লেখা রয়েছে জেলার বিভিন্ন স্থানে।
মুন্সিগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মো. নাজমুল হুসাইন বলেন, ‘ভাষা সব সময় সচল ও গতিশীল। সে জন্য সময়ের পবির্তনের সঙ্গে সাথে ভাষার বানানরীতিও প্রয়োজনের তাগিদে পরিবর্তিত হয়। শিক্ষিত লোকেরাও অনেক সময় বাংলা বানানে ভুল করে থাকেন। বানানে ‘শ, ষ এবং স’-এ তিনটি বানানে বিভ্রান্তি রয়েছে। কোন বানানে কোন ‘স’ বসবে সেটি নিয়ে আমরা অনেকেই সচেতন নই। ‘ণ এবং ন’ বসবে সেটাও নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। বাংলা ভাষার উৎস মতে, নানা ধরণের শব্দ রয়েছে। বিদেশি শব্দে সব সময় ‘স এবং শ’ ব্যবহ্নত হবে। ‘ষ’ ব্যবহ্নত হবে না। তাই শুদ্ধ বানান লেখার জন্য বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানান নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও যারা নানা ধরণের ভাষার সঙ্গে কাজ করে তারা সেটি অনুসরণ করলে সহজ হয়ে যায়।’
মুন্সিগঞ্জ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট’র বাংলা বিভাগের জুনিয়র ইন্সপেক্টর মুহাম্মদ আহছানুল্লাহ বলেন, ‘একই বানানে বিভিন্ন ধরণের প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। সেটা ভাষার মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করছে। বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানান অনুসরণ করলে বাংলা বানানে বিশৃঙ্খলা দূর হতে পারে এবং সরকারি পর্যায়ে এই উদ্যোগটি গ্রহণ করতে হবে।’
মিরকাদিম হাজী আমজাদ আলী ডিগ্রি কলেজের সহকারি অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘বাংলা একাডেমির বানানরীতি ভালোভাবে ফলো করা উচিত। তা না হলে জাতিগত দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়বো। যুক্ত বর্ণগুলো সম্পর্কে আমাদের জানা উচিত। অনেক শিক্ষিত লোকও সচেতন না। দেখা যাচ্ছে, একটি বানান লিখতে লিখতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই বাংলা বানানের নিয়মটি আমরা মানতে চাইছি না।’
কবি, কলামনিস্ট ও মুন্সিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহম্মদ মতিউর রহমান বলেন, ‘তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা বানানরীতিতে একটি পাঠ্যবই বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা জানবে ও শিখবে। জেলার শিক্ষার্থী ও জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য জেলার প্রশাসনেরও দায়িত্ব আছে।’
জেলার বানানে অসঙ্গতি থাকার কথা জানিয়ে মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা বলেন, ‘পরিসখ্যান বিভাগ থেকে একটি জরিপ চালানো হচ্ছে, দেশের জেলাগুলোর সঠিক বানান কিভাবে লেখা হবে। পরিসখ্যান বিভাগের ওই ডকুমেন্টটি পেলে সবার মাঝে তা প্রচারণার ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘মুন্সিগঞ্জ’ বানানের ক্ষেত্রে আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ফলো করি। ১৯৮৪ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলা হওয়ার পর জেলার বানান যেভাবে দীর্ঘ ঈ-কার (‘ী’) দিয়ে অর্থাৎ ‘মুন্সীগঞ্জ’ গ্যাজেটেড হয় জেলা প্রশাসন থেকে আমরা সেভাবে লেখার চেষ্টা করছি।’
অবজারভার
Leave a Reply