মাদক নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে স্বর্ণ লুটপাটে!

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মুন্সীগঞ্জ জেলার সহকারী পরিচালক এস এম সাকিব হাসান ওরফে সাকিব শিকদার। তার মূল দায়িত্ব ছিল এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ করা। অথচ মাদক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে সরকারি এই কর্মকর্তা নেমে পড়েন স্বর্ণ লুটপাটে। নিজেই একটি চক্র গড়ে তোলেন। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারকেন্দ্রিক স্বর্ণ কারবারিদের টার্গেট করে এ চক্রের মাধ্যমে একের পর এক স্বর্ণের চালান ডাকাতি করে আসছেন তিনি। এই অপকর্মে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় ব্যবহার করেন সরকারি ডাবল পিকআপভ্যান। সরকারি ওই গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঠ-১৩-৬৮৫৯। স্বর্ণ লুটপাটের সময় নিজের সংস্থার পোশাকও পরতেন তিনি।

এখন পর্যন্ত সাকিবের এই চক্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট আটজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা অন্তত দুই দফায় ৩২০ ভরি স্বর্ণ গায়েব করেছেন। ভুক্তভোগী স্বর্ণ কারবারি ও সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সরকারি কর্মকর্তার স্বর্ণ লুটের সিন্ডিকেট নিয়ে এমন চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সিদ্দিকুর রহমান নামের মুন্সীগঞ্জের এক স্বর্ণ কারবারিকে টার্গেট করেন সাকিব ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাঁতীবাজার থেকে ৯০ ভরি স্বর্ণ কিনে মুন্সীগঞ্জ রওনা হন সিদ্দিকুর। স্বর্ণগুলো ছিল বার আকারে। সিদ্দিকুরের কেনা ৯টি বারের প্রতিটির ওজন ছিল ১০ ভরি করে। তাঁতীবাজার থেকে জিন্দাবাহার পার্ক এলাকায় যাওয়ার পর এই স্বর্ণ কারবারির গতিরোধ করা হয়। পুলিশ পরিচয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাকে একটি ডাবল পিকআপভ্যানে তোলা হয়। পরে সব স্বর্ণ লুট করে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় জেলখানার কাছে রাস্তার ওপর তাকে ফেলে যায় ওই চক্র। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন ওই ব্যবসায়ী।

সিদ্দিকুরের বর্ণনা অনুযায়ী, জিন্দাবাহার পার্ক ও আশপাশের ওই সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে কে বা কারা জোর করে ডাবল পিকআপভ্যানে তুলছে। তাদের পরনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো খাকি ড্রেস। এরপর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, জীবন পাল নামের এক সোর্সের সঙ্গে ঘটনার দিন সন্দেহভাজন একটি নম্বরে অনেকবার কল আদান-প্রদান হয়েছে। ওই দিন সন্দেহভাজন নম্বরটি থেকে শতাধিক কল গেছে বিভিন্ন নম্বরে।

পরে জানা যায়, জীবনের সঙ্গে যার এক দিনে এতবার কথা হয়েছিল, তিনি মুন্সীগঞ্জের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাকিব শিকদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া সাকিবের গ্রামের বাড়ি নড়াইলে। ৩৪তম বিসিএসের মাধ্যমে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে যোগ দেন তিনি। জীবনের সঙ্গে অনেক পুরোনো সম্পর্ক তার। তাঁতীবাজার থেকে কেউ বড় চালানের স্বর্ণ কিনে বের হলেই জীবন ফোন করতেন সাকিবকে। পুলিশ পরিচয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গাড়িতে তুলে অস্ত্র দেখিয়ে হাত-পা ও চোখ বেঁধে ফেলা হতো। এরপর ওই স্বর্ণ লুট করা হতো। জীবন ছাড়াও তাঁতীবাজারকেন্দ্রিক আরও দু’জন সাকিবকে এই অপকর্মে সহযোগিতা করে আসছিলেন। তারা হলেন স্বর্ণ দোকানের কর্মচারী রতন কুমার সেন ও মো. হারুন। নিজের দপ্তরের আরও চারজনকেও সাকিব এই সিন্ডিকেটে যুক্ত করেছেন। তারা হলেন- মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এএসআই মো. এমদাদ, সিপাহি আমিনুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন ও গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সাকিব ১৭ জানুয়ারি থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বেসিক ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস কোর্সে অংশ নিতে ঢাকায় ছিলেন। এই কোর্সটি তিন মাস মেয়াদের।

সিদ্দিকুরের কাছ থেকে লুট করা ৯০ ভরি স্বর্ণের মধ্যে সাকিব তার ভাগে পেয়েছেন ৫০ ভরি। বাকি স্বর্ণ ভাগ করে নিয়েছেন তার সহকর্মী ও সোর্স। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেও এই চক্র একইভাবে আরেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২৩০ ভরি স্বর্ণ লুট করেছিল। ২৩টি বারে বিভক্ত ছিল ওই স্বর্ণ। তাঁতীবাজার থেকে স্বর্ণ কিনে বাড়ি ফেরার পথে ওই ব্যবসায়ীকে গাড়িতে তুলে ভয়ভীতি দেখিয়ে মাওনা পর্যন্ত নিয়ে যায় সাকিব ও তার গ্রুপ। এরপর সব স্বর্ণ লুট করে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।
স্বর্ণ লুটের এ ঘটনায় এরই মধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন জীবন ও রতন। বর্তমানে তারা কারাগারে। তাদের দু’জনেরই বাড়ি কুমিল্লায়।

দীর্ঘদিন ধরেই ভাগ হিসেবে স্বর্ণের বার পাওয়ার বিনিময়ে মাদক কর্মকর্তা সাকিবকে অনৈতিক এই কাজে সহায়তা করে আসছিলেন তারা। কেউ স্বর্ণ কিনে তাঁতীবাজার থেকে ফিরলেই তাকে অনুসরণ করতেন সোর্স জীবন। পথের মধ্যে চক্রের সদস্যদের চিনিয়ে দিতেন টার্গেট ব্যক্তিকে। জীবনকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতেন স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী রতন। স্বর্ণ লুটের এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা সাকিবসহ তিন সদস্যকে গতকাল রিমান্ডে নিয়েছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ।

একটি সূত্র জানায়, গত সোমবার রাতে পুলিশ ভাটারা এলাকা থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাকিবকে গ্রেপ্তার করে। তার ব্যাগ থেকে সিদ্দিকুরের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া পাঁচটি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। পাঁচটি বারের ওজন ৫০ ভরি। এ ছাড়া অন্য আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে স্বর্ণ বিক্রির আট লাখ ৮৬ হাজার টাকা। এদিকে, সাকিবের সহযোগী হিসেবে এই চক্রে থাকা তিন সদস্য সিপাহি আমিনুল, এএসআই এমদাদ ও ড্রাইভার ইব্রাহিমকে পুলিশের হাতে গতকাল মঙ্গলবার তুলে দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি গাড়ি ও পোশাক নিয়ে স্বর্ণ লুটের চক্রে জড়িয়ে পড়ার এমন ঘটনা উদ্বেগজনক। মাদক কারবারিদের মোকাবিলায় অধিদপ্তরের সদস্যদের অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাদের কার্যকর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

মুন্সীগঞ্জের লাকী জুয়েলার্সের কর্ণধার ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, ঘটনার দিন পাঁচ-ছয়জন গাড়িতে তুলেই তার চোখ বেঁধে ফেলে। দু’জনের মাঝখানে বসানো হয় তাকে। ভয় দেখিয়ে সব স্বর্ণ, টাকা-পয়সা ও মোবাইল কেড়ে নেয়। ঘণ্টাখানেকের মতো গাড়িতে ঘোরানো হয়। এরপর কেরানীগঞ্জে গাড়ি থেকে নামিয়ে চোখ খুলে দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছি; তবে ভীত নই।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের লালবাগ বিভাগের ডিসি বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, ব্যবসায়ী সিদ্দিকুরের করা মামলার তদন্ত চলছে। এই চক্রের কয়েকজন পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। এর বেশি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বারকে ফোন করা হলে ‘কিছু বলতে পারব না’ বলে কল কেটে দেন।
তাঁতীবাজার বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি রঞ্জন বিশ্বাস সমকালকে বলেন, ব্যবসায়ীরা কে, কীভাবে স্বর্ণ কেনাবেচা করেন- এটা তারাই ভালো জানেন। কারও ব্যাপারে কেউ নাক গলায় না।

সাহাদাত হোসেন পরশ
সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.