শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) উপমহাদেশের কিংবদন্তি আলেম ও হাদিসবিশারদ। ধারণা করা হয়, তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলা ভাষায় তিনিই সর্বপ্রথম সহিহ বুখারির পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন। একই সঙ্গে প্রায় ছয় দশকের বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন মাদরাসায় বুখারির পাঠদান করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় বহু আলেম তাঁর সরাসরি ছাত্র। দীর্ঘদিন হাদিসের চর্চা ও পাঠদানের সঙ্গে যুক্ত থাকায় উপমহাদেশের দ্বিতীয় আলেম হিসেবে ‘শায়খুল হাদিস’ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯১৯ সালে বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জ) জেলার ভিরিচ খাঁ অঞ্চলে আল্লামা আজিজুল হকের জন্ম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু। এখানে তিনি মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর ও আবদুল ওয়াহহাব পীরজি হুজুর (রহ.)-কেও শিক্ষক হিসেবে পান। কিছুদিন পর এই তিন মনীষীর সঙ্গে তিনি ঢাকার আশরাফুল উলুম, বড় কাটারায় আশরাফুল উলুম মাদরাসায় চলে আসেন এবং এখানেই দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। ভারতের ডাভেলে জাফর আহমদ উসমানী (রহ.)-এর কাছে পুনরায় সহিহ বুখারির পাঠ নেন। ডাভেল যাওয়ার পথে মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুরে থানভি (রহ.)-এর খলিফা মাওলানা আসআদুল্লাহ রামপুরি (রহ.)-এর সঙ্গে ইসলাহি সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আল্লামা ইদরিস কান্ধলভি (রহ.)-এর কাছে দারুল উলুম দেওবন্দে তাফসির পড়েন।
বড় কাটারা মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৫২ সালে জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগ মাদরাসায় সহিহ বুখারির পাঠদানের জন্য নিয়োগ পান। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এখানে ইসলামী আইন, হাদিস ও তাফসিরসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করেন। এখানে দীর্যদিন বুখারির পাঠদান করেন এবং সারা দেশে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। একসময় তিনি শায়খুল হাদিস উপাধি লাভ করেন। জামিয়া কোরআনিয়াতে থাকতেই তাঁর সহিহ বুখারির বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রথম সারির একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিথি শিক্ষক হিসেবে বুখারির দরস দিয়েছেন।
১৯৮৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া এখন দেশের অন্যতম ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খ্যাতি অর্জন করেছে। এ ছাড়া তিনি আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের শরিয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনীতিতেও তাঁর সরব ভূমিকা ছিল; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। তা ছাড়া আজীবন বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে বাবরি মসজিদ শহীদ হলে তিনি তার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক লংমার্চের ডাক দেন, যা বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। তা ছাড়া বিশ্ব শান্তির বার্তা নিয়ে ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাতে হাফেজ্জি হুজুরের সঙ্গে এক সফরে দেশ দুটির প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
কালের কন্ঠ
Leave a Reply