রিয়াদ হোসাইন: মুন্সিগঞ্জে নানা সমস্যায় জর্জরিত ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্পটি হারিয়ে যেতে বসেছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় চাহিদা হারাচ্ছে মাটির তৈরি পণ্যসামগ্রী। তবে আসছে বৈশাখী মেলাসহ গ্রীষ্মের বেশ কয়েকটি মেলাকে কেন্দ্র করে মৃৎ শিল্পীরা মাটির বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সরেজমিনে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার পুরা ও আব্দুল্লাহপুর এবং শ্রীনগর উপজেলার তন্তর এলাকায় দেখা যায়, মাটি দিয়ে খেলনা ঘোড়া, গরু, হাঁস, মুরগি, পুতুল, ব্যাংক তৈরি করছেন। একই সাথে বিভিন্ন সাইজের হাড়ি-পাতিলসহ সাংসারিক কাজে ব্যবহারযোগ্য কলস, মটকি, দইয়ের হাড়ি, ঢাকনাসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র তৈরি করছেন এখানকার মৃৎ শিল্পীরা। তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে আকর্ষণীয় একেকটি মাটির সামগ্রী। এগুলো রোদে শুকানোর পরে আগুনে পুড়ানো হচ্ছে। পরে করা হচ্ছে রংয়ের কাজ। এসব কাজে বাবা-মাকে সহযোগিতা করছেন সন্তানরাও। কাজ সম্পূর্ণ হলে মজুদ করে রাখা হচ্ছে বিক্রির জন্য।
সম্প্রতি পুরা ও তন্তর এলাকার কুমারপাড়া গেলে কথা হয় মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে তারা জানান, অনেক বছর যাবত মাটির বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী তৈরি করা হলেও এখন তা হারিয়ে যেতে বসেছে। এখানকার মানুষজন যুগ যুগ ধরে মাটির তৈরি জিনিস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও, বর্তমানে এ পেশা ছেড়েছেন অনেকে। এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এখানকার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। মানবেতর জীবন যাপন করছেন কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। তবে পৌষ মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত জেলাজুড়ে বিভিন্ন মেলায় মাটির জিনিস বিক্রি হয়। ফলে এই সময় ব্যস্ততা বাড়ে কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পীদের। এই সময়টা বাদ দিলে বছরের অন্যান্য সময় মাটির জিনিস তেমন বিক্রি হয় না। এছাড়া জেলায় মৃৎশিল্পীদের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রির সুনির্দিষ্ট কোনো জায়গাও নেই।
পুরা এলাকার বাসিন্দা কৃষ্ণ ঘোষ (৫৫) সেই ১০ বছর বয়স থেকেই বাবা শ্যামল ঘোষে সঙ্গে মাটির জিনিস তৈরি করছেন। তখন এ পাড়ার ২৩টি পরিবারের সদস্যরা মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, ধূপদানি, বিয়ের ঘট, ঢাকনা ও শিশুদের নানা খেলনা তৈরি করতেন। তবে মৃৎপাত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ কাজ করে আর সংসার চালানো যায় না।
তিনি বলেন, বাজারে এখন মাটির জিনিসের চাহিদা কমে গেছে। সবাই অ্যালুমিনিয়াম আর প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করে। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। অনেকে কারখানা, গার্মেন্টস আর মুদির দোকানে কাজ করছে।
পাড়ার দুই নারী নিয়তি ঘোষ ও ঝুনু ঘোষ স্বামীর পাশাপাশি মাটির জিনিস তৈরি করেন বলে জানান। তারা বলেন, এই পর্যন্ত কখনো কোনো সরকারি সহায়তা পাননি পাড়ার মৃৎশিল্পীরা। বাধ্য হয়ে তারা বেশি সুদে বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছেন। তবে কঠোর পরিশ্রম করেও সংসার চালানোর মতো আয় করতে পারছেন না এই পেশার লোকজন। অনেকের আয় দিনমজুরের চেয়েও কম।
মৃৎশিল্পী সুখেন্দু ঘোষ জানান, প্রতিটি পাতিল ও কলসি বানাতে তার প্রায় ৩০ টাকা খরচ পড়ে। তবে বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকায়। প্রতি মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকার জিনিস বিক্রি হলেও লাভ থাকে মাত্র ছয় থেকে সাত হাজার টাকা।
তিনি আরও বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এ শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব।
তন্তর এলাকার মৃৎ শিল্পী সমীর পাল বলেন, গত বৈশাখে করোনাকালীন সময়ে আমাদের কোন ব্যবসা-বাণিজ্য হয়নি। বিক্রি না থাকায় কয়েক মাস কোন কাজও ছিল না। পরিবারের সবাই কর্মহীন হয়ে পড়ে। লকডাউন শেষে মাটির এসব জিনিসপত্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে কিছুটা বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে। এবছর বৈশাখী মেলাকে সামনে রেখে কাজ শুরু করেছি। মাসব্যাপী মাটির বিভিন্ন সামগ্রী বানানোর কাজ চলবে। এখান থেকে পাইকারি ভাবেও বিক্রি করা হয়। অনেকেই এই পেশাটি ছাড়ছেন। তার পরেও অনেকটাই বাধ্য হয়ে বাপ দাদার পেশাটি ধরে রাখার চেষ্টা করছি আমরা।’
দৈনিক অধিকার
Leave a Reply