রাহমান মনি: মা হচ্ছেন এমনই একজন নারী, যিনি গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম তথা সন্তানকে বড় করে তোলেন, তিনিই অভিভাবকের ভূমিকা পালনে সক্ষম ও মা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। প্রকৃতিগতভাবে একজন নারী বা মহিলাই সন্তানকে জন্ম দেয়ার অধিকারীনি। গর্ভধারণের ন্যায় জটিল এবং মায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অবস্থানে থেকে এ সংজ্ঞাটি বিশ্বজনীন গৃহীত হয়েছে।-(উইকিপিডিয়া)।
তবে, সন্তান জন্ম দিলেই যেমন মা হওয়া যায় না, তেমনি সন্তান জন্ম না দিয়েও মায়ের ভুমিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন এমন উদাহরণও কিন্তু কম নয়।
গর্ভে ধারন না করেও যে সত্যিকার অর্থেই মায়ের ভুমিকায় দায়িত্ব পালন করে মায়ের সন্মান পাওয়া যায় তেমন-ই একজন মায়ের কথা জানান দেয়াই আজকের এই প্রয়াস।
নাম তাঁর কাগাওয়া সেতসুকো বয়স ৬৫ । বলছি ১৯৮৮ সালের কথা।
একজন ধার্মিক খ্রীস্তান। ধর্মচর্চা সব সময় করে থাকেন। স্বয়ং পোপ এর রোববার চার্চে যাওয়া মিস হলেও তাঁর মিস হয় না।
প্রথমে কাগাওয়া সেতসুকো’র সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ হয়নি।
প্রবাস জীবনের স্বাভাবিকতা অনুযায়ী কয়েক বন্ধু মিলে একটি বাসায় থাকি। এর মধ্যে এলাকার বড় ভাই আরিফ চৌধুরী (বর্তমান জ্বালানি মন্ত্রী নসরুল্লাহ হামিদ বিপুর মামা)’র সাথে কাগাওয়া সেতসুকো’র সাথে পরিচয় হয় কোন এক যায়গায়। কাগাওয়া সেতসুকো একটু একটু ইংরেজী বলতে পারলেও আরিফ ভাই একেবারেই জাপানি ভাষা জানেন না। বাধ্য হয়েই আমার শরণাপন্ন ।
ভদ্র মহিলার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম খুবই হেল্পফুল একজন মানুষ। আমার সাথে কথা বলে নিজ থেকেই আগ্রহ প্রকাশ করলেন দেখা করবেন এবং এমাদের জীবনযাপন স্বচক্ষে অবলোকন করবেন। তবে এইজন্য আমাদের কাজে যেন কাজ থেকে ছুটি নিতে না হয় অর্থাৎ তিনি বলতে চাচ্ছেন আমাদের আয়ের উপর যেনো প্রভাব না পড়ে।
পূর্ব নির্ধারিত যথা সময়ে তিনি আসলেন। একজন বাঙ্গালী মা যেমন সন্তানদের কাছে গেলে কিংবা সন্তান বাড়ীতে আসলে সন্তানের জন্য এটা সেটা প্রস্তুত রাখেন কিংবা নিয়ে যান। তেমনি তিনি আমাদের জন্য নিজে হাতে বানানো বিভিন্ন খাবার, নিজ বাড়ীর আঙিনায় গাছের ফল নিয়ে আসলেন। সাথে ম্যাঙ্গো জুস।
এসেই তিনি আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, তোমাদের দুশ্চিন্তার কারন নেই। কারন, এখানে হারাম কোন জিনিস ব্যবহার করা হয়নি যাতে তোমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। আমি খৃস্টান হলেও ইসলাম সম্পর্কে আমার ভালো ধারনা আছে বলতে পারো। এরপর খুব যত্ন সহকারে নিজ হাতে আমাদের মুখে তুলে দিলেন। যেমনটি একজন মা-ই করতে পারেন সন্তানের জন্য। তিনিও বললেন, মনে কর জাপানে আমিই তোমাদের একজন মা ( জাপানী ভাষায় বলা হয় ‘ওকাসান’)।
বাপ মা, স্বজনহীন এই প্রবাস জীবনে আমরাও একজন মা পেয়ে যারপর নেই খুশী। আজ প্রায় তিন যুগ পরেও সেই মুহূর্তটির কথা স্মৃতিতে অম্লান। এবং সেই থেকে শুরু জাপানে একজন মায়ের স্নেহের ছায়ায় পথ চলা।
সেই থেকে জাপানের যাবতীয় দেখভাল করে যেতে লাগলেন। স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব কিছুর যোগান সহ বাসা ভাড়া নেয়ার, ইমিগ্রেশন এর ভিসার জন্য গ্যারান্টর হিসেবে নিজেকে আমাদেরকে চিরঋণের আবদ্ধে আবদ্ধ করে রাখলেন।
১৯৯০ সালে আরিফ ভাই দেশে চলে গেলেন। রয়ে গেলাম আমি। তিনি শুধুই আমার মা হিসেবে রয়ে গেলেন তিনি। নিজেরও ২টি মেয়ে রয়েছে তবুও তিনি আমার মতো অনেক বাংলাদেশীদেরই মায়ের স্নেহ দিয়ে যাচ্ছেন। যদিও জাপানে প্রতিষ্ঠা পা’বার পর অনেকেই তাকে ভুলে গেছেন। তা নিয়ে তাঁর কোন আফসোস নেই। বলেন, ওরা ভালো থাকলেই ভালো।
১৯৯১ সালে বিয়ে করি। শাশুর শাশুরীর অমতে তাদের মেয়ে একটি লাগেজ নিয়ে চলে আসলে বিপদে পড়ে জাপানে স্নেহময়ী মাকে এবং বাংলাদেশে জন্মদাতা পিতা কে ফোন করি। তাদের পরামর্শ এবং অনুমতি নিয়ে জাপানের ইসলামিক সেন্টারে গিয়ে কলেমা পড়িয়ে প্রথমে মুসলিম বানিয়ে তারপর মুসলিম রীতিতে বিয়ে করি।
বিয়ে করার পর ওকা সান খুব সুচারুভাবে সব কিছু সামাল দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে শশুর বাড়ীর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে দেন।
এরই মধ্যে ১৯৯২ সালে আমাদের ঘর আলোকিত করে ছোট্ট আরেকটি মায়ের ( আমার মেয়ে ‘ইফা’) আগমন ঘটে। প্রথম নাতনি পেয়ে শশুর বাড়ীর লোকজন যেমন বেজায় খুশী তেমনি খুশী ওকাসানও।
সবার আনন্দের মধ্যে ১৯৯৫ সালে জন্ম নেয় আমাদের ছেলে আশিক। দেশ থেকে আমার আব্বা এবং মা আসেন নাতির টানে।
আব্বা এবং মা জাপান আসাতে ওকা সান তাদেরকে তাঁর বাড়ীতে নেয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন। নাছোড়বান্দা। নিয়েই ছাড়বেন।
যেই কথা সেই কাজ। একদিন এসে নিয়েও গেলেন।
আর এই মেহমানদারীর জন্য প্রস্তুতিও কম নয়। নিজস্ব আয়োজনের পাশাপাশি হালালফুড (তখন আজকের মতো হালালফুড এর এতো দোকান ছিল না) এর দোকান থেকে বাজার করা ছাড়াও উভয়ের জন্য নতুন লেপ তোষক থেকে শুরু করে একদিনের ব্যবহার্য যাবতীয় সব কিছুই প্রস্তুত রেখেছেন। এমন কি নামাজ পড়ার ব্যবস্থাও।
এরপর থেকে ওকা সান তার স্নেহের ছায়া আমাদের মাথায় রেখে নিয়মিত ভাবেই আমাদের সব কিছুই দেখাশুনা করে যেতেন। যাতায়াত ছিল নিয়মিত। আর একবার বাসায় আসলে সব কিছু নিয়ে আসতেন এবং বসে নিজ হাতে আমাকে না খাওয়ালে যেন তাঁর আত্মতৃপ্তি আসতো না।
বয়স (তখন প্রায় ৯০ বছর) জনিত কারনে ২০১২ সালের পর থেকে আর আসতে পারতেন না। তবে, টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে বড়দিনে এবং নতুন বছরে শুভেচ্ছা জানাতে কখনোই ভুল হয়নি আমার। শুভেচ্ছা কার্ড পাঠানো সহ টেলিফোন করতাম নিয়মিত।
২০২০ সালে করোনায় আঘাত হানার পরও আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল । আমাদের নিয়ে সব সময় চিন্তা করতেন।
ব্যস্ততার কারনে হঠাৎ করে বেশ কিছুদিন ওকাসানের সাথে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি।
গত বছর বড়দিনে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য যথারীতি ওকা সান কে ফোন করলে অপ্রত্যাশিত ভাবে ধরেন তার হাজবেন্ড। কিন্তু আমি যতদূর জানি সব সময় ফোন ধরেন এর ব্যতিক্রম কখনোই পাইনি। যোগাযগ, কথাবার্তা, আদান প্রদান সব সময় মায়ের সাথেই হ’তো যদিও তার হাজব্যান্ড এবং বড় মেয়ের সাথে বেশ কয়েকবারই দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল।
ফোন ধরেই তিনি বললেন, ‘মনি সান’ সেইতো ফোন করলা তা কয়েকদিন আগে করলেই ভালো হ’তো।
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কেন কি হয়েছে ? ওকা সান এর কিছু হয়েছে কি ?
জাপানের প্রথা অনুযায়ী বয়স ( ১০০ ছুই ছুই করছে ) জনিত কারনে স্বীয় কাজ এবং চলাফেরায় অক্ষম হলে তাকে হাসপাতালে রাখা হয় আমৃত্যু। হাসপাতালের চিকিৎসক এবং সেবক/সেবিকারা হয়ে উঠেন তার আপনজন।
তার হাজবেন্ড বললেন, তোমার মা মারা গেছেন। তোমাকে জানানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে আমরা কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। এমন কি তোমার মায়ের নিজ হাতে করা তালিকায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আগতদের তোমার নাম থাকা সত্বেও তোমাকে আমরা ডাকতে পারিনি। কারন তোমার যোগাযোগের ঠিকানা আমার জানা ছিলনা।
আমি জানি তিনি এসব বলছেন নিজেকে আড়াল করার জন্য। কারন, আমার ফোন নাম্বার, ঠিকানা সবই তাঁর জানার কথা। প্রতিবছর একাধিকবার শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ের সবই সংরক্ষিত করা আছে। এছারাও ওকা সান কর্তৃক তৈরি কৃত তালিকায় আমার যোগাযোগের ঠিকানা লিখা থাকার কথা। এটাই এখানকার নিয়ম রীতি। নিশ্চয় ওকা সানেরও তা জানার কথা।
কিন্তু সে সময় আমার মাথায় মোটেও তা কাজ করেনি। ওকা সান নেই এটাই বিশ্বাস করতে এবং নিজেকে সামলে নিতে সময় লেগে যায়। মুহূর্তের মধ্যে মনের আর্কাইভ থেকে বিভিন্ন স্মৃতি চোখের মনিটরে ভাসতে থাকে। আর, নিজেকে অপরাধী, অকৃতজ্ঞ মনে হয়। যে মা, বলার আগে সব কিছু করে দিতেন, নিজ হাতে খাবার মুখে তুলে দিতেন, জঠরে ধারন না করলেও তার চেয়েও বেশী করেছেন এমন একজন মহিয়সী মায়ের মৃত্যুর সময় পাশে থাকা তো দূরের কথা, খবরটি পর্যন্ত আমার জানা নেই! এই অযোগ্যতাই আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল সেই সময় । হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাওয়ার ফুরসত ছিলনা। আজও প্রশ্ন করা হয়নি। মা ই তো নেই, প্রশ্ন করে লাভ কি ?
এমন একজন মহিয়সী নারী যিনি কিনা একজন ধার্মিক হয়েও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মালম্বী এবং ভিনদেশের অচেনা লোকদের এমন অকৃত্তিম ভালোবাসা দিয়ে, স্নেহের ছায়া দিয়ে, সময় এবং অর্থ দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে মাতৃসেবা দিয়ে গেছে তাকে একজন মহিয়সী নারী ছাড়া আর কি ই বা বলা যেতে পারে ?
অথচ তার অন্তিম ইচ্ছার প্রতিফলন আমি ঘটাতে পারিনি, রেখে যাওয়ার তালিকায় নাম থাকা সত্বেও তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারিনি। এ আমারই ব্যর্থতা। কোন অজুহাতই এখানে টিকবে না।
আসলেই আরো অনেকের মতো আমি তার অযোগ্য একটি সন্তান। অনেকেই জীবিত থাকা অবস্থায় অযোগ্যতার প্রমান রেখেছেন। আর আমি তার মৃত্যুর পর। মৃত্যুর খবরটিও সঠিক সময়ে পাইনি। সর্বদা যোগাযোগ না রাখার কারনে। পার্থক্য শুধু এইটুকুই । অযোগ্য তো অযোগ্যই।।
rahmanmoni@gmail.com
Leave a Reply