রাজধানীর উত্তরায় শ্রীলঙ্কার এক নাগরিকের বিরুদ্ধে এক তরুণ নিরাপত্তাকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি ইউরোপ টেক্স ফ্যাশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কান্ট্রি ম্যানেজার। ভুক্তোভোগী ওই তরুণ ভয়ে ও লজ্জায় চাকরি ছেড়ে চলে যায়। প্রাথমিকভাবে থানায় জানানো হলেও মীমাংসার জন্য ভিকটিমের পরিবারকে টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এমনকি পুলিশ প্রথমে মামলাও নেয়নি। পরে ভিকটিমের মা ঢাকায় এসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) জানালে তাদের উদ্যোগে থানা পুলিশ মামলা নিতে বাধ্য হয়। গ্রেফতার করা হয় ওই শ্রীলঙ্কান নাগরিককে। বর্তমানে কারাগারে রয়েছে সে।
শনিবার (২৬ জুন) সকালে ভিকটিমের মা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছেলে কোরআনে হাফেজ। তার বাবা নেই। তার বয়স ২০ বছর। গতবছরের নভেম্বরে ঢাকায় নিরাপত্তাকর্মীর কাজ নিয়েছিল। কিন্তু তার সঙ্গে অনেক বড় অন্যায় ঘটেছে। যে কারণে সে পালিয়ে এসেছে। কারও কাছে বলতেও পারেনি। ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ মীমাংসার জন্য চাপ দিয়েছিল। মামলা নিতে চায়নি। পরে পিবিআইর এক কর্মকর্তার কাছে ঘটনা বলার পর মামলা হয়েছে।’
ভালো ব্যবহার আর উপহারের টোপ
তিনি আরও বলেন, ‘গতবছরের ১ নভেম্বর গুলশানের একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে গার্ড পদে যোগ দেয় আমার ছেলে। কোম্পানি তাকে উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সড়কের ১৮ নম্বর বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করতে পাঠায়। সে সেখানে অপর সিকিউরিটি গার্ড রিপন (২১), আরফান উদ্দিন (৫৫) ও ম্যানেজার জাকারিয়ার (৩৩) সঙ্গে ডিউটি করতো। সেখানেই নিচতলায় রিপন ও জাকারিয়ার সঙ্গে তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ভবনের সপ্তম তলায় ইউরোপ টেক্স ফ্যাশন-এর একটি গেস্ট হাউজ আছে। ওই হাউজে কোম্পানির কান্ট্রি ম্যানেজার শ্রীলঙ্কার নাগরিক প্রসন্ন গমিজ থাকতো।’
মুন্সীগঞ্জের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক এই মা বলেন, ‘গমিজ প্রথমে আমার ছেলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার শুরু করে। ছেলেও তার টুকটাক কাজকর্ম করে দিতো। সে আমার ছেলেকে ভালো চাকরির আশ্বাস দেয়। চাকরি দেওয়ার কথা বলে এক লাখ টাকা চায়। আমার ছেলে আমাকে জানালে আমি ৬০ হাজার টাকা যোগাড় করি। ছেলে ওই টাকা রিপন ও জাকারিয়ার সামনেই ২০ এপ্রিল প্রসন্ন গমিজাকে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু গমিজ আর আমার ছেলেকে চাকরি দেয়নি। শুরু করে তাল-বাহানা। এরপর সে আমার ছেলেকে বাজে প্রস্তাব দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২১ এপ্রিল তারা ছেলেক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে নতুন কাপড় উপহার দিয়ে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। এ অবস্থায় গমিজ আমার ছেলের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় স্পর্শ করে। তখন আমার ছেলে কোনোমতে পালিয়ে আসে। আমার ছেলে খারাপ কাজে রাজী না হওয়ায় সে একপর্যায়ে ভয়-ভীতি দেখাতে শুরু করে।’
তিনি বলেন, ‘২৬ মে ভোর ৪টার দিকে আমার ছেলেকে ডিউটিরত অবস্থায় প্রসন্ন গমিজ ওই ভবনের নিচতলায় ম্যানেজার জাকারিয়ার রুমে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক বলাৎকার করে। তখন আমার ছেলের চিৎকারে সিকিউরিটি গার্ড রিপন ও ম্যানেজার জাকারিয়া এসে আসামির কবল থেকে ছেলেকে বিবস্ত্র অবস্থায় উদ্ধার করে। ঘটনাটির ভিডিও করেছিল আসামি। সেটা পুলিশের কাছে জমাও দেওয়া হয়েছে।’
৫০ হাজার টাকায় মীমাংসার প্রস্তাব
বলাৎকারের ঘটনা ও টাকা নেওয়ার বিষয়ে বাড়াবাড়ি করলে প্রাণনাশের হুমকিসহ ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে গমিজ। কিন্তু তরুণ নিরাপত্তাকর্মী লোকলজ্জা ও প্রাণনাশের ভয়ে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে যায়। প্রথমে তিনি তার পরিবারকে কিছুই বলেননি। তবে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের সহযোগিতায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি জিডি করেন। কয়েকদিন পর উত্তরা পশ্চিম থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা ভিকটিমের মাকে ফোন করেন। তিনি ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিষয়টি মীমাংসার প্রস্তাব দেন।
ভিকটিমের মা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই আকিব নূর আমাকে বলেন, একটি দুর্ঘটনা যেহেতু ঘটেছে, আপনারা কিছু টাকা নিয়ে মীমাংসা করেন। তবে আমি রাজী হইনি। আপস করবো না। আমি বিচার চাই।’
উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই আকিব নূর এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এমন কোনও প্রস্তাব দিইনি।’
উত্তরা পশ্চিম থানার এমন প্রস্তাবের পর ভিকটিমের মা মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় যান। তিনি পিবিআইর সহযোগিতায় মামলা করেন। এরপরই গ্রেফতার করা হয় শ্রীলঙ্কান নাগরিক প্রসন্ন গমিজকে।
মামলার এজাহারে ভিকটিমের মা অভিযোগ করেন, ‘গমিজের সহযোগী ইউরোপ টেক্সের প্রোডাকশন ম্যানেজার মহিউদ্দিন ও রনিসহ অজ্ঞাতনামা দুই-তিন এসে জাকারিয়াকে বলে আমার স্যার অন্যায় করেছে। আপনাদের টাকা দেবো। বাড়াবাড়ি করবেন না।’
প্রসন্ন গমিজকে ২০ জুন আদালতে হাজির করে পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করেন পিবিআই ঢাকা মেট্রোর অর্গানাইজড ক্রাইমের পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম। আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে গমিজকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পিবিআই’র এই তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, প্রধান আসামি গ্রেফতার হয়েছে। মামলার তদন্ত চলছে। দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
এদিকে ঘটনার এক মাসের বেশি পাল হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি ভুক্তভোগী তরুণ। পরিবারের সদস্যরা জানান, তিনি কোনও কাজে যোগ দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। লোকজন দেখলে ভয় পাচ্ছেন। সহজ-সরল গোছের হওয়ায় ঘটনাটি তার মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলা ট্রিবিউন
Leave a Reply