মু‌ন্সিগ‌ঞ্জের হা‌টে পাওয়া যা‌চ্ছে নান্দ‌নিক ঘর (ভিডিও)

ব.ম শামীম: কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকে। আবহাওয়ার সঙ্গে ঘর দ্রুত ঠান্ডা ও গরম হয়। এসব ঘরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়। প্রয়োজনে বিক্রিও করা যায়। ফলে এসব ঘরের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অনেক দিন ধরে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ডিজাইনের কাঠ ও টিনের ঘর। কাঠ ও টিনের তৈরি এসব নান্দনিক ঘর বিক্রির জন্য জেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ঘর বিক্রির হাটও। মুন্সিগঞ্জের লোকজনের পাশাপাশি কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ঢাকা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলা থেকে ক্রেতারা এসব ঘর কিনতে আসেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এক সময় বার্মার লোহাকাঠ, শালকাঠ ও টিন দিয়ে এই ঘর নির্মাণ করা হলেও বর্তমানে নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ, সেগুন কাঠ ও টিন দিয়ে অধিকাংশ ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। লোহাকাঠ দিয়ে নির্মিত ঘরগুলো সাধারণত ৬০ বছর থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। একেকটি টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত ঘর ১ থেকে ৩ তলা পর্যন্ত হয়ে থাকে। হাটে ২-৮ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের ঘর বিক্রি হয়। তবে অনেকেই বাড়িতে কাঠমিস্ত্রি এনে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়েও ২-৩ তলা প্রাসাদের মতো টিন ও কাঠ দিয়ে ঘর নির্মাণ করেন। নান্দনিক ডিজাইনের কারণে মুন্সিগঞ্জের সবকটি উপজেলায় এ ধরনের ঘরের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

বিশেষ করে মুন্সিগঞ্জের প্রবাসীদের প্রথম পছন্দ বাহারি ডিজাইনের টিনের ঘর। মুন্সিগঞ্জ সদর, টঙ্গীবাড়ী, লৌহজং, সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারসহ রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছে এসব ঘর বিক্রির হাট। ঘর বানিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে জমির ওপর সাজিয়ে রাখেন বিক্রেতারা। ক্রেতারা তাদের পছন্দের ঘরটির বাস্তব রূপ দেখে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যান।

মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বালিগাওঁ, কুন্ডের বাজার, দিঘিরপাড়, বাড়ৈইপাড়া, কালিবাড়ি, কামারখাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘর বিক্রির হাট রয়েছে। শ্রীনগর উপজেলার শ্রীনগর ও দোহার সাড়কের বালাশুর বটতলা ও কামারগাঁও এলাকার রাস্তার পাশে খোলা স্থানে ঘর তুলে রেখেছেন ঘর ব্যবসায়ীরা। এছাড়া একই উপজেলার ভাগ্যকুল এলাকায়ও রয়েছে ঘর তৈরির কারখানা। সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর, ইছাপুড়া লৌহজং উপজেলার নওপাড়া, মালিলংক, হাট বুগদিয়া, বড় নওপাড়া এলাকায়ও ঘর বিক্রির হাট রয়েছে।

ঘর নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ দিয়ে বেশির ভাগ ঘর তৈরি করা হয়। এছাড়া সেগুন, শাল, বাচালু ও ওকান কাঠের ঘরের চাহিদাও রয়েছে। একটি এক তলা ঘর নির্মাণ করতে ৫-৭ জন শ্রমিকের ৮-১০ দিন সময় লাগে। ঘরগুলো বিক্রি হয় ২ লাখ টাকা থেকে ৮ লাখ টাকায়। এর চেয়ে বেশি দামেও ঘর পাওয়া যায়। তবে সেগুলো অর্ডার করার পর বানিয়ে দেওয়া হয়।

প্রথমে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গাছ কিনে আনেন ঘর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মহাজনরা। এরপর গাছগুলোকে ‘স’ মিলে কেটে সাইজ করা হয়। সেগুলোতে নকশা করেন নকশা মিস্ত্রিরা। টিনগুলো বিভিন্ন স্থান থেকে কিনে আনেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ডিজাইন করা টিন কিনতে পাওয়া যায়। ঘরগুলো জমির ওপর দাঁড় করাতে ব্যবহার করা হয় কাঠ, সিমেন্ট ও লোহার খুঁটি। একটি পূর্ণাঙ্গ ঘর প্রস্তুত করতে কয়েক দফা কাজ করেন শ্রমিকরা।

এদিকে বাহারি এসব ঘর নির্মাণে গোপালগঞ্জের শ্রমিকদের আলাদা চাহিদা রয়েছে মুন্সিগঞ্জে। এ জেলায় গোপালগঞ্জের প্রায় এক হাজার শ্রমিক ঘর নির্মাণ কাজে জড়িত বলে কাঠমিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

ঘর তৈরির জন্য মুন্সিগঞ্জের প্রসিদ্ধ স্থান হচ্ছে সদর উপজেলার বজ্রযোগীনি ইউনিয়নের চুরাইন গ্রাম। এ গ্রামের প্রায় সব বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত ভিটায় বিক্রির জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের ঘর তুলে রাখা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, চুরাইন গ্রামের রাস্তার পাশের বিভিন্ন ভিটায় বিক্রির উদ্দেশ্যে তুলে রাখা হয়েছে ঘর। একটি ঘর বিক্রির পর ওই স্থানে নতুন আরেকটি ঘর নির্মাণ করার কাজ করছেন শ্রমিকরা।

চুরাইন গ্রামের ‘সুমন ঘর বিতানে’র ম্যানেজার মো. হাসান বলেন, আমরা মাসে ১০-১২টি ঘর বিক্রি করতে পারি। কিন্তু করোনার কারণে বর্তমানে বিক্রি কম। এছাড়া টিন ও কাঠের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঘরের দামও বেড়েছে। এজন্য ক্রেতারা ঘর কিনতে এসেও দাম শুনে পরে কিনবেন বলে চলে যাচ্ছেন।

ঘর তৈরির কাজে নিয়োজিত মিস্ত্রি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার আনন্দ বালা বলেন, আমরা এখানে বিদেশি নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ ও বাচালো কাঠ দিয়ে ঘর নির্মাণ করি। এই কাঠ দিয়ে নির্মিত ঘরগুলো প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত টিকে। এই ঘরগুলোর এতো চাহিদা যে মুন্সিগঞ্জের বাইরেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা জেলাসহ বিভিন্ন জেলার লোকজন এসে ঘর কিনে নিয়ে যান।

গোপালগঞ্জের আরেক কাঠমিস্ত্রি রতন বলেন, একেকটি ঘর নকশাসহ নির্মাণ করতে চারজন মিস্ত্রির কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় লাগে। এখানে নির্মিত একটি ঘর ৩ থেকে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এর চেয়ে বেশি দামের ভালো ঘর তৈরি করতে হলে আমাদের আগে অর্ডার দিতে হয়। অর্ডার দিলে আমরা সেভাবে বানিয়ে দিই।

আরেক মিস্ত্রি মিল্টন বলেন, এখানে তৈরি করা ঘর ক্রেতারা এসে কিনে নিয়ে যান। আবার অনেক ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী তাদের নিজস্ব খরচে ঘরগুলো খুলে নিয়ে প্রতিটি অংশ আলাদাভাবে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের দেখানো জায়গায় আবার জোড়া লাগিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের ঘর ব্যবসায়ী আওলাদ ট্রেডার্সের মালিক আওলাদ মৃধা বলেন, ১৫ বছর ধরে এই পেশায় আছি। এখানে বিভিন্ন মডেলের ঘর আছে। যেমন- ‘২৩ ঘর’ (দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২৩ ফুট), আই ২৩, টব, নাক-টিন। এসব ঘরে বিভিন্ন মানের টিন ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অর্ডার অনুযায়ী ঘর বানিয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশ ঘরে ব্যবহৃত কাঠগুলো নাইজেরিয়ান।

ঢাকা পোষ্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.