মুন্সীগঞ্জে যা ঘটেছিল : অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের অতি উৎসাহে সংঘর্ষের সূত্রপাত

রাজীব আহাম্মদ ও কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু: উত্তেজনা থাকলেও গত বুধবার মুন্সীগঞ্জে বিএনপির কর্মসূচি শুরুতে পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিনহাজ-উল-ইসলাম গাড়ি থেকে নেমে মিছিলের ব্যানার কেড়ে নিয়ে লাঠিচার্জ করলে সংঘর্ষ বাধে। বিএনপি কর্মীরা তখন পুলিশের দিকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছোড়েন। পুলিশ একটি ট্রাকের পেছনে আশ্রয় নেয়। যুবদল কর্মী শাওন ভূঁইয়া ইট ছুড়তে ছুড়তে ট্রাকের কাছে গিয়ে একটি বাঁশ কুড়িয়ে নেন। এ সময় পেছন থেকে ছোড়া ইটের আঘাত তাঁর ঘাড়ে বা মাথায় লাগে। একই সময়ে ট্রাকের পেছন থেকে যেখানে পুলিশ সদস্যরা ছিলেন, সেখান গুলির শব্দ শোনা যায়। বন্দুকের ধোঁয়া দেখা যায়। ওই মুহূর্তেই সড়কে লুটিয়ে পড়েন শাওন। পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

গত বুধবারের সংঘর্ষের কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ সমকাল পেয়েছে, তাতে এসব দৃশ্য দেখা গেছে। সংঘর্ষের প্রত্যক্ষদর্শী, সেই সময়ে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের বক্তব্যে ঘটনার একই রকম বিবরণ পেয়েছে সমকাল।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং নেতাকর্মীদের ‘হত্যা’র প্রতিবাদে বুধবার বিকেল ৩টায় মুক্তারপুর পুরোনো ফেরিঘাটে মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ ছিল। গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এখনও সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ইটপাটকেল। যে হাজি আবদুল মান্নাফ ফকির মার্কেটের সামনে শাওন আহত হয়েছিলেন, সেখানে আগুনের আঁচে মগডাল পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া বট গাছটিও রয়েছে।

বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি মামলায় শাওনসহ ১ হাজার ৭৬৫ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে কেউ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। ফেরিঘাটে যে কোল্ডস্টোরেজের সামনে বিএনপির সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল, এর পাশে কয়েকটি ভাতের হোটেল রয়েছে। এর একটির এক শ্রমিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

তিনি জানান, ফেরিঘাট এলাকাটি বিএনপি অধ্যুষিত। এর ২০০ গজ দূরে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল হাইয়ের বাড়ি। তাঁর ছোট ভাই সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদও ছিলেন সমাবেশস্থলে। বিএনপি কর্মীরা বুধবার দুপুর থেকেই কোল্ডস্টোরেজের সামনে জমায়েত হতে শুরু করেন। তিন দিক থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে তাঁরা আসতে থাকেন ট্রাকে তৈরি মঞ্চের দিকে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মুক্তারপুর-সিপাহিপাড়া সড়ক দিয়ে একটি মিছিল আসছিল ফেরিঘাটের দিকে। একই সময়ে মুন্সীগঞ্জ শহরমুখী রাস্তা দিয়ে গাড়িতে আসেন সদর সার্কেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজ-উল-ইসলাম। তিনি গাড়ি থেকে নেমেই মিছিলকারীদের ব্যানার কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এর কয়েক সেকেন্ড পর পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন বিএনপি কর্মীরা। এই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ব্যানার কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়ার আগে সমাবেশ অন্যদিনের মতোই ছিল।

মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরে দলীয় কার্যালয় থাকলেও গত কয়েক বছরে সেখানে কর্মসূচি করতে পারেনি বিএনপি। গত মাসে মিছিলের চেষ্টা করলেও আওয়ামী লীগের ধাওয়ায় তা পণ্ড হয়। বিএনপির কার্যালয়ে তালা দেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা। জেলা সদরে না পেরে মুক্তারপুর ফেরিঘাটে সভা-সমাবেশ করে বিএনপি।

সংঘর্ষস্থলে পাহারায় থাকা পুলিশের একজন সহকারী উপপরিদর্শকের (এএসআই) সঙ্গে কথা হয়। যিনি বুধবারের সংঘর্ষের সময়ও দায়িত্বে ছিলেন। তিনি জানান, বিএনপি নিয়মিতই ফেরিঘাটে সমাবেশ করে। নেতারা বক্তৃতা করে চলে যান। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের নজির নেই। বুধবার সংঘর্ষের প্রস্তুতি ছিল না পুলিশের। দু’জন নারী কনস্টেবলসহ মাত্র ১৬ জন পুলিশ ছিলেন। ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকজন সদস্য। বিকেল সোয়া ৩টার দিকে কোল্ডস্টোরেজের সামনে জমায়েত বিএনপি নেতাকর্মীরা মিছিল করে মোড়ের দিকে আসার চেষ্টা করেন। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারেকুজ্জামানসহ ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ সদস্যরা হাতে হাত ধরে ব্যারিকেড তৈরি করে তাঁদের বাধা দেন। মিছিল না করে শুধু ফেরিঘাটে সমাবেশ করতে বলে পুলিশ। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান রতন, উপজেলা আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা ওসির সঙ্গে কথা বলে কর্মী নিয়ে ফেরিঘাটের দিকে চলে যান।

তাহলে সংঘর্ষ কেন হলো- এ প্রশ্নে ওই এএসআই সমকালকে বলেছেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসার পর মিছিল থেকে জুতা ছুড়ে মারা হয়। এরপর ইট মারা হয়। পুলিশ সংখ্যায় ছিল কম। প্রাণ বাঁচাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ওসি, গোয়েন্দা পুলিশের ওসিসহ পুলিশ সদস্যরা মান্নাফ ফকির মার্কেটের পূর্বদিকে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের পেছনে আশ্রয় নেন। সেখানেও টিকতে না পেরে কয়েকজন পুলিশ সদস্য প্রাণ বাঁচাতে ধলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপ দেন। নদীতেও পুলিশের ওপর ইট ছোড়া হয়। খালি গায়ে ও খালি পায়ে যে ব্যক্তিকে শটগান দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে, সংবাদপত্রের ছবিতে তিনি নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তিনি গোয়েন্দা পুলিশের সদস্য। ওই এএসআইও জানালেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হঠাৎ মারমুখী না হলে সংঘর্ষের খুব একটা আশঙ্কা ছিল না। তিনি জানান, পুলিশ সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত ছিল না। লাঠি, টিয়ার গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেটের মতো সাধারণ অস্ত্র ছিল। অনেক পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। মোটরসাইকেলে দেওয়া আগুন মার্কেটে ছড়ালে সেখানে শাটার বন্ধ করে আশ্রয় নেওয়া পুলিশ সদস্য, বিএনপি নেতাকর্মী ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের প্রাণহানিসহ বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল।

সংঘর্ষের মামলায় আসামি হয়ে বিএনপি নেতারা পলাতক। কামরুজ্জামান রতন, মহিউদ্দিন আহমেদসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে কয়েকজন কর্মীর অভিযোগ, জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছবিসংবলিত ব্যানার কেড়ে নিয়ে পা দিয়ে মাড়ান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। এতে কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। মোড়ের ডান দিকে একটি নির্মাণাধীন ভবনের জন্য আনা ইট ছিল। সেগুলো রাস্তায় ফেলে ভেঙে পুলিশের দিকে ছোড়েন কর্মীরা। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় পাশে স্তূপ করে রাখা কয়েক হাজার ইট এখনও রয়েছে। এই কর্মীদের ভাষ্য, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অতি-উৎসাহী হয়ে মারমুখী না হলে আর দশটি কর্মসূচির মতো বুধবারের সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হতো।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিজেও আহত হয়েছেন। ইটের আঘাতে তাঁরও মাথা ফেটেছে। সেলাই লেগেছে। অতি-উৎসাহী মারমুখী হওয়ার অভিযোগ নাকচ করে মিনহাজ-উল-ইসলাম সমকালকে বলেছেন, বিএনপির সমাবেশের অনুমতি ছিল না। তাদের কেন (সমাবেশ করতে) দেওয়া হবে?

অনুমতি না থাকলে ওসি কেন বাধা দেননি সমাবেশে- প্রশ্নে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সমকালকে বলেছেন, বিভিন্নভাবে অনুরোধ করা হয়েছিল সমাবেশ না করতে। আমি নিজেও তাদের (বিএনপিকে) মাইকে অনুরোধ করেছি। তারা সরেনি। হঠাৎ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। বিএনপি কর্মীরা আক্রমণ করার পর ব্যানার কেড়ে নেওয়া হয় বলে দাবি করেছেন মিনহাজ-উল-ইসলাম।

তবে সমকাল সংঘর্ষের যে ভিডিও ফুটেজ পেয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার সঙ্গে ঘটনার হুবহু মিল পাওয়া গেছে। একটি ফুটেজে দেখা গেছে, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লাঠিপেটা শুরু করার পর অন্য পুলিশ সদস্যরাও যোগ দেন। সেখানে তখন হাজারের বেশি বিএনপির নেতাকর্মী ছিলেন। তাঁরা পাল্টা ধাওয়া দিলে পুলিশ পিছু হটে। পুলিশ সদস্যের গায়ে ইট এসে পড়েছিল। নিরাপত্তা হেলমেট ছিল না মিনহাজ-উল-ইসলামসহ অধিকাংশ পুলিশ সদস্যের। তাঁরা আত্মরক্ষার্থে ট্রাকের পেছনে আশ্রয় নেন। ইট লাগায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সবার আগে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

১ মিনিট ১১ সেকেন্ডের আরেকটি ভিডিও ফুটেজ পেয়েছে সমকাল। তাতে দেখা গেছে, কালো প্যান্ট, বুকে সাদা রঙের লেখা এবং হাতায়-কাঁধে সাদা স্ট্রাইপের কালো টি-শার্ট পরা ছিল শাওনের। তাঁর মাথায় ছিল কালো ক্যাপ। অন্যদের সঙ্গে তাঁকে দু’বার ঢিল ছুড়তে দেখা যায়। হঠাৎ তিনি দৌড়ে খালি হাতে ট্রাকের দিকে যান। এর পেছনেই ছিলেন আশ্রয় নেওয়া পুলিশ সদস্যরা। ফুটেজটির ১ মিনিট ৫ সেকেন্ডের সময় শাওন ট্রাকের পাশ থেকে একটি বাঁশ কুড়িয়ে দেন। ১ মিনিট ৭ সেকেন্ডের সময় পেছন থেকে হাফ প্যান্ট ও সাদা-লাল ফুলের কালো শার্ট পরা এক তরুণের ছোড়া ইট শাওনের ঘাড়ে বা পিঠে লাগে। ঠিক একই সময় একটি গুলির শব্দ শোনা যায়। ট্রাকের পাশে বন্দুকের ধোঁয়া দেখা যায়। ভিডিও অনুযায়ী, এক সেকেন্ডের মধ্যে ইটের আঘাত ও গুলি লাগে শাওনের। তিনি লুটিয়ে পড়েন সড়কে। সুরতহাল রিপোর্ট অনুযায়ী, শাওনের কপালের ডান দিকে এবং মাথার পেছনে গভীর ক্ষত রয়েছে। শাওনের মুখোমুখি ছিল পুলিশ। তাঁর ডান পাশে গুলির ধোঁয়া দেখা গেছে।

তবে যে তরুণের ছোড়া ইট শাওনের শরীরে লাগতে দেখা গেছে তাঁর পরিচয় জানতে পারেনি সমকাল। ভিডিওতে শাওনকে শনাক্ত করেছেন তাঁর এক আত্মীয়।

সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.