যাত্রী সঙ্কটে লঞ্চ কেটে বিক্রির শঙ্কা

নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ রুটে চলাচলকারী দারশিকো-১ নামের লঞ্চটি নারায়ণগঞ্জের ঘাটে পৌঁছায় সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে। ঘাটে ভেড়ার পর একে একে নেমে আসেন সব যাত্রী। গুনে দেখা গেলো লঞ্চটি থেকে মাত্র ২১ জন যাত্রী নেমেছেন। এ চিত্র শুধু একদিনের না, নিত্যদিনের এই যাত্রী সংকট লঞ্চ মালিক-শ্রমিকদের কপালে ফেলেছে চিন্তার ভাজ। মালিকরা বলছেন এ অবস্থা চলতে থাকলে লঞ্চ কেটে স্ক্র্যাপ আকারে বিক্রি ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকবে না তাদের।

যাত্রী সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে চালক মো. মিনহাজ মিয়া বলেন, যাত্রী সংকট এখন তীব্র হয়েছে। এখন লঞ্চের ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রীও পারাপার করতে পারি না। অনেক সময় এক-তৃতীয়াংশ যাত্রীও হয় না। এ অবস্থায় আমাদের জীবন জীবিকা নিয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

লঞ্চ মালিকরা বলছেন, লঞ্চ ঘাটে মালামাল বাবদ অতিরিক্ত টাকা আদায়, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানা কারণে যাত্রী সংকট তৈরি হয়েছে। তাছাড়া যাত্রী সংকটের ফলে ২০টি লঞ্চ কেটে (স্ক্র্যাপ হিসেবে) বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই লঞ্চ ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া ছাড়া কোনও পথ খোলা থাকবে না।

লঞ্চ চালক মো. মিনহাজ আরও বলেন, ‘সকালে একটু যাত্রী পেলেও দুপুর হতেই যাত্রী সংখ্যা কমে যায়। এখন অধিকাংশ ট্রিপে ১৫-২০ জন যাত্রীর বেশি হয় না। অথচ আগে ৬০-৭০ জন যাত্রী নিয়মিত যাতায়াত করতো। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ রুটে আগে ২৫টি লঞ্চ চলাচল করতো, যা কমে এখন সাতটিতে নেমে এসেছে। এরপরও যাত্রী মিলছে না। কখনও যাত্রী সংকটের ফলে ফাঁকা লঞ্চ নিয়েই যাতায়াত করতে হয়।

ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে এই রুটে পাঁচ টাকা ভাড়া বাড়িয়ে ডেকে ৩৫ ও চেয়ারে ৫০ টাকা আদায় করা হচ্ছে।

জীবিকা নির্বাহ কষ্টের হয়ে গেছে জানিয়ে চালক মিনহাজ আরও বলেন, যাত্রী সংকট চলতে থাকলে মালিকরা লঞ্চ কেটে বিক্রি করে দেবেন। তাতে করে আমাদের মতো শ্রমিকরা পড়বে বেকায়দায়। এমনিতেই অনেকগুলো লঞ্চ কেটে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। সেসব লঞ্চের শ্রমিকরা চাকরি হারিয়ে অনেকেই পেশা বদল করেছেন, আবার কেউ অন্যত্র চলে গেছেন।

তবে যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চের সংখ্যা কমে যাওয়ায় দীর্ঘ সময় লঞ্চ ঘাটে বসে থাকতে হয়। অথচ আগে ২০ মিনিট পরপর মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন রুটের লঞ্চ চলাচল করতো। কিন্তু এখন লঞ্চের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অনেক দেরি হয়। এ কারণে সড়কপথে যাতায়াত করতে হচ্ছে। তাছাড়া লঞ্চ ঘাটে প্রবেশ ফি ১০ টাকার পাশাপাশি মালামালের জন্য বাড়তি টাকা দিতে হয়। সড়কপথে এই বাড়তি টাকা খরচ করতে হয় না। এ কারণে নৌ-রুট বদলে সড়কপথ বেছে নিয়েছেন যাত্রীরা।

বাংলাদেশ নৌ পরিবহন (যাত্রী) সংস্থা নারায়ণগঞ্জ জোন ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নারায়ণগঞ্জ জেলা অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ২০ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজ রূপসী-৯ এর ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এম.এল আফসার উদ্দিন ডুবে ১০ জন মারা যান। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ থেকে চলাচলকারী সব সানকেন ডেকের লঞ্চকে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। এতে যাত্রীরা রুট পরিবর্তন করে সড়ক পথ বেছে নেয়। পরে যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে বিশাল আকৃতির হাইডেকের চারটি লঞ্চ নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল শুরু করে। তবে মাস খানেক পরে চার দফায় পাঁচটি রুটে ৪৪টি লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। এতে রাজধানী থেকে আনিত চারটি লঞ্চ অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু এই টানাপোড়নের মধ্যে যাত্রীরা সড়কপথে চলাচল শুরু করেছেন। তাই আগের মতো আর যাত্রী মিলছে না।

নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চ মালিক মোহাম্মদ হোসেনের দুটি লঞ্চ চলাচল করে। তার কাছে ব্যবসার পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ভালো নেই। যাত্রী সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে ভাড়াও বেড়েছে। কিন্তু লঞ্চের সংখ্যা কম থাকায় যত্রতত্র লঞ্চের শিডিউল মেলে না। ফলে লঞ্চ পেতে যাত্রীদের একটু বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। অপরদিকে সড়কপথে সেই বিড়ম্বনা নেই। যে কারণে নৌপথে যাত্রীসংখ্যা কমছে।

আরেক লঞ্চ মালিক ও বাংলাদেশ নৌ পরিবহন (যাত্রী) সংস্থা নারায়ণগঞ্জ জোনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান রাজা বলেন, ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানা কারণে যাত্রী সংকট তৈরি হয়েছে। অর্ধেকের বেশি যাত্রী সংখ্যা কমেছে। যাত্রী সংকটের ফলে আমাদের অনেকগুলো লঞ্চ কেটে বিক্রি করা হয়েছে। আমার দুটি লঞ্চের মধ্যে একটি কেটে বিক্রি করে দিয়েছি। এখন মুন্সীগঞ্জ রুটে দারশিকো নামে একটি লঞ্চ চলাচল করছে।

বাংলাদেশ নৌ পরিবহন (যাত্রী) সংস্থা নারায়ণগঞ্জ জোনের সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ৭০টি লঞ্চের মধ্যে ২০টি লঞ্চ কেটে (স্ক্র্যাপ) বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আর ৪৪টি লঞ্চ চলাচলের অনুমোদন দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ, বাকি ছয়টি লঞ্চ খুব শিগগিরই চলাচলের অনুমোদন পাবে।

যাত্রী সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধীরে ধীরে যাত্রী সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সবগুলো রুটে এই সংকট দেখা দিয়েছে। এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে- যাত্রীদের ঘাটে প্রবেশ করতে হলে প্রবেশ ফি ১০ টাকা দিতে হয়। পাশাপাশি যাত্রীদের সঙ্গে থাকা মালমাল বাবদ আরও অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। কিন্তু সড়কপথে চলাচলে এই বাড়তি টাকা গুনতে হয় না। যে কারণে যাত্রীরা নৌপথ বিমুখ হয়ে পড়েছেন। এছাড়া মাঝখানে বেশ কিছুদিন লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় মূলত যাত্রীরা সড়কের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন বলে জানান তিনি। এভাবে চলতে থাকলে বাকি লঞ্চগুলোও কেটে বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের উপ-পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) বাবু লাল বৈদ্য বলেন, লঞ্চে যাত্রী সংখ্যা অনেক কমেছে। কারণ আগে প্রতি ২০ মিনিট অন্তর অন্তর লঞ্চ পাওয়া যেতো, এখন প্রায় এক ঘণ্টা পর লঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছে। এই এক ঘণ্টা যাত্রীরা বসে থাকতে চায় না। যে কারণে তারা সড়কপথে যাতায়াতকে বেছে নিয়েছে। তবে খুব শিগগিরই আরও ছয়টি লঞ্চ বাড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ওই লঞ্চগুলো অনুমোদন পেলে সময়ের ব্যবধান কমে আসবে, তখন যাত্রীরা অল্প সময়ের মধ্যে লঞ্চ পেয়ে যাবেন। আশা করছি তখন যাত্রীও বাড়বে।

নিউজজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.