মুন্সিগঞ্জে মজুত আলু নিয়ে বিপাকে কৃষক-ব্যবসায়ী

আরাফাত রায়হান সাকিব: একদিকে হিমাগারে এখনো অবিক্রীত জেলায় উৎপাদিত আলুর এক-তৃতীয়াংশ। অন্যদিকে পাইকারি বিক্রিতে মিলছে না ন্যায্যমূল্য। এমন পরিস্থিতিতে আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মুন্সিগঞ্জের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। কেজিতে তিন-পাঁচ টাকা আর ৫০ কেজির বস্তায় ২০০ থেকে আড়াইশো টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। ফলে আলু সংরক্ষণ করে দিশেহারা জেলার কৃষক ও মজুতকারীরা। ফলে আগামী মৌসুমে আলু আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন অনেকে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জে চলতি মৌসুমে ১০ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদিতে হয়েছে। ছয় উপজেলায় সচল আছে ৬৪টি হিমাগার। এসব হিমাগারে এখনো মজুত ২ লাখ ৭৮ হাজার ১৭৯ মেট্রিক টন আলু।

সরেজমিনে দেখা যায়, হিমাগারের শেডের মেঝেতে বিছানো শত শত মণ আলু, ভেতরে মজুত করা হয়েছে বস্তায় বস্তায়। শেডে শ্রমিকরা বাছাই করে পচে যাওয়া আলু ফেলে দিচ্ছেন।

কৃষক ও ব্যবসায়ীরা জানান, জেলায় সচল থাকা ৬৪ হিমাগারের একই চিত্র। বিক্রিতে ভাটা পড়ায় সময়ের সঙ্গে হিমাগার থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে আলু যাচ্ছে না খুচরা বাজারে। এর মধ্যে আসছে আলু আবাদের মৌসুম। তাই মজুত এই বিপুল পরিমাণ আলু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

তারা আরও বলছেন, খুচরা বাজারে ভালো দাম থাকলেও হিমাগার পর্যায়ে মিলছে না ন্যায্যমূল্য। প্রতি কেজি আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণে ব্যয় ২০-২১ টাকা। বর্তমানে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৬-১৭ টাকায়। এতে কেজিতে লোকসান গুনতে হচ্ছে চার-পাঁচ টাকা। এদিকে, সপ্তাহের ব্যবধানে কমছে দাম, তাই ভারী হচ্ছে লোকসানের পাল্লা। এর সঙ্গে আলু পচে নষ্ট হওয়া তো রয়েছেই।

কৃষক শফিক জানান, পাঁচ হাজার বস্তা আলু কোল্ডস্টোরেজে রাখছি। আমার বস্তাপ্রতি খরচ হয়েছে সাড়ে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। প্রতি বস্তায় ২০০ টাকা লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, প্রচুর পরিমাণে আলু আছে কিন্তু বিক্রি করতে পারছি না।

কৃষক জমির আলী বলেন, গত মৌসুমে বৃষ্টিপাত হওয়ায় অনেক জমিতে রোপণ করা বীজ নষ্ট হয়ে যায়। তাই দুবার বীজ রোপণে খরচ দ্বিগুণ হয়েছে। প্রথমে বাজার কম থাকায় লস দিয়ে কিছু বিক্রি করেছিলাম। তখন ভাবছিলাম বাকি আলু পরে বিক্রি করলে লাভ হবে। এখন দেখা দেখা গেলো, প্রথমে বেচেও লস, কোল্ডস্টোরেজে রেখেও লস।

মো. ফরিদ নামে এক ব্যাপারী বলেন, লাভের আশায় কোল্ডস্টোরেজে রেখে এখন লস। অনেক আলু পচে যাচ্ছে। সব জিনিসের দাম বেশি, আর আলুর দাম নেই। যেই আলু আছে চৈত্র মাসেও শেষ হবে না। সরকার যদি এখন উদ্যোগ নিয়ে বাইরের দেশে কিছু আলু রপ্তানি করে তাহলে পাইকারিতে দামও কিছুটা বাড়বে। পাইকারি দাম যদি ২২-২৩ টাকা থাকে তাহলে কেজিতে এক থেকে তিন টাকা লাভ হবে। এতে কৃষক-ব্যাপারীরা কিছুটা রক্ষা পাবে।

মো. সজিব নামে এক কৃষক বলেন, সময়মতো আলু বিক্রি করতে না পারলে শেষে আলু পচে নষ্ট হবে। তখন নদীতে ফেলতে হবে। এছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। বছর বছর মাইর খাইতে খাইতে আমাদের সর্বহারা অবস্থা।

দুশ্চিন্তায় হিমাগার সংশ্লিষ্টরা

এদিকে কৃষক-ব্যাপারীদের লোকসান হলে হিমাগার মালিকদেরও পড়তে হবে ক্ষতিতে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দ্রুত সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তাদের।

সদর উপজেলার মুন্সিরহাট এলাকার সুলতান কোল্ডস্টোরেজের সুপারভাইজার মোস্তফা সরকার বলেন, আমাদের হিমাগারে ২ লাখ ৯৪ হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজার বস্তা আলু বিক্রি হয়েছে। সামনে আর বাকি দেড়-দুইমাস। মজুত আলু কবে বিক্রি হবে তা এখন বলতে পারছি না। কৃষক-ব্যাপারীদের মতো আমরাও দুশ্চিন্তায়।

সদর উপজেলার মুক্তাপুরের দেওয়ান কোল্ডস্টোরেজের ব্যবস্থাপক মো. ইব্রাহিম বলেন, আলু বাজারে যেভাবে যাওয়ার কথা ছিল সেভাবে যায়নি। আলু রোপণের জন্য হিমাগার থেকে কৃষকদের প্রচুর পরিমাণে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। এখন কৃষকরা লোকসানে পড়লে ঋণের সে টাকা ফেরত পাওয়া কষ্টকর হয়ে যাবে। অনেক সময় আলুর বস্তা রেখেই চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে লোকসানে পড়তে হয় হিমাগার মালিকদের।

তিনি আরও বলেন, হিমাগারে পাইকারি পর্যায়ে দাম কম থাকলেও খুচরা বাজারে বেশি। তার মানে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী লাভ করছেন। এ বিষয়ে মনিটরিং প্রয়োজন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ কল্যাণ কুমার সরকার বলেন, বিপুল পরিমাণ আলু মজুতের কথা শুনেছি। মজুত বেশি থাকায় বাজারে দাম কম। তবে লোকসান এড়াতে আগামীতে কৃষকদের আলুর পাশাপাশি উচ্চমূল্যের ভিন্ন ফসলের আবাদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আগামীতে কম আবাদ হলে মজুত আলু বিক্রির সুযোগ বাড়বে। তখন লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

এমআরআর/জেআইএম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.