টঙ্গিবাড়ীর তালতলী-গৌরগঞ্জ খালে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। এক মাসে ভাঙনে ৩৩ বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। বিয়ের পর স্বামী আমারে এই বাড়িতে এনে তুলেছিল। এই বাড়িতে কত হাসি–আনন্দে দিন কাটছে। কত সুখ–দুঃখের স্মৃতি। সন্তনেরা বড় হইছে। তাদের ঘরেও এখন সন্তান হইছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর জীবনের শেষ সময়টা তার ঘরেই কাটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চোখের সামনে বসতভিটা নদীতে চলে গেছে।’
গত শনিবার বিকেলে অনেক আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার আউটশাহী ইউনিয়নের কাইচাইল গ্রামের প্রয়াত হাসমত আলী ব্যাপারীর স্ত্রী সালেহা বেগম (৭৫)। গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে চলা তালতলী-গৌরগঞ্জ খালের তীব্র স্রোতে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। গত এক মাসে খালের ভাঙনে বিলীন হয়েছে ৩৩ পরিবারের বসতভিটা। এর মধ্যে গত দুই দিনে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সালেহা বেগমসহ ১০ পরিবারের বসতভিটা বিলীন হয়। ভাঙন অব্যাহত থাকায় এখন ঝুঁকিতে আছে ওই এলাকার ৬০-৭০টি পরিবার।
শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, কাইচাইল গ্রামে ভাঙন চলছে। ওই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তালতলী-গৌরগঞ্জ খালে স্রোত বইছে। খালের মধ্য দিয়ে চলছে বালুবাহী বড় বড় বাল্কহেড। স্রোত ও বাল্কহেডের ঢেউয়ের আঘাতে খালপাড়ের মানুষের বসতভিটা ও জমি বিলীন হচ্ছে।
পরম মমতায় আগলে রাখা বসতভিটা চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাওয়ায় ঘরের দরজায় বসে বিলাপ করছিলেন সালেহা বেগম। তাঁর ছেলে আলমগীরের পাকা ভবন ভাঙার কাজ চলছে। এর আগে খালের ভাঙনে বিলীন হয়েছে সালেহা বেগমের তিন ছেলে জাহাঙ্গীর, মোতালেব ও শাহ আলমের বসতভিটা।
তালতলী–গৌরগঞ্জ খালটি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার গৌরগঞ্জ এলাকার পদ্মা নদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে। খালটি টঙ্গিবাড়ী ও সিরাজদিখান উপজেলা হয়ে তালতলী এলাকার ধলেশ্বরী নদীতে মিলিত হয়েছে।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, কয়েক বছর আগেও খালটি মরা খালের মতো ছিল। ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে খাল থেকে বালু তোলায় এবং তীব্র স্রোত ও খাল দিয়ে প্রতিদিন শত শত বাল্কহেড চলাচল করায় কয়েক বছর ধরে লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত বছর টঙ্গিবাড়ী উপজেলার শিলিমপুর এলকার বেশ কিছু বসতভিটা এই খালে বিলীন হয়ে যায়। এ বছর শিলিমপুরের পাশের গ্রাম কাইচাইলে ভাঙন চলছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে কাইচাইল গ্রামের মনির হোসেন, জাহাঙ্গীর খান, ইমরান খান, মোতালেব ব্যাপারী, শাহালম, আলমগীর, হাসমত আলী ব্যাপারী, খালেক শেখ, বারেক শেখসহ ৩৩ জনের বসতভিটা ওই খালে বিলীন হয়ে গেছে।
খালের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত তাসলিমা বেগম (৬৫) বলেন, ‘খালে বসতভিটা বিলীন হইছে। আমাদের থাকার জায়গা নেই। অনেক অসহায় অবস্থায় আছি। খাওয়ার ব্যবস্থাও নেই। কোথায় যাব জানি না।’
আউটশাহী ইউপি চেয়ারম্যান সেকান্দার আলী ব্যাপারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খালের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করছি। ১৬ পরিবার খুব বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। ৬০–৭০টি পরিবার ভাঙনের হুমকিতে আছে। ভাঙন আটকাতে দ্রুত কোনো ব্যবস্থা না নিলে কয়েক দিনের মধ্যে কাইচাইল গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে টঙ্গিবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মু. রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘সরকারিভাবে ভাঙনকবলিত প্রতিটি পরিবারকে সব ধরনের সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা করা হচ্ছে। ভাঙনকবলিত স্থানে দ্রুত বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার উদ্যাগ নেওয়া হবে। বালু উত্তোলনের সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খালের তীরের মাটি বিক্রির দায়ে গতকালও এক ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ভাঙন বন্ধ করতে বাল্কহেড চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে।’
প্রথম আলো
Leave a Reply