গ্যাস–সংকটে রান্নায় কষ্ট

গ্যাস না পাওয়ায় নিরুপায় হয়ে অনেকে মাটির চুলা, এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার এবং বৈদ্যুতিক চুলা দিয়ে রান্নার কাজ সেরে নিচ্ছেন। ঘরের বাইরে মাটির চুলা পেতে বসেছেন মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার উত্তর ইসলামপুর এলাকার গৃহিণী নার্গিস বেগম। চারদিকে রান্নার সামগ্রী ছড়ানো-ছিটানো। চুলা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। চোখ ডলতে ডলতে চুলার মুখে ফুঁ দিচ্ছিলেন তিনি। প্রায় দুই মিনিট চেষ্টার পর আগুন জ্বলে। তারপর তিনি শুরু করেন রান্নাবান্না। এটি এখন তাঁর প্রতিদিনের কাজ। মাটির চুলায় রান্না না হলে পাঁচজনের সংসারটির সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।

আক্ষেপ করে নার্গিস বলেন, ‘তিন মাস আগেও দিনের সময় মোমবাতির মতো টিমটিম করে চুলা জ্বলত। দিনে গ্যাস না থাকলেও রাত ১১টা থেকে পরের দিন ভোররাত পাঁচটা পর্যন্ত সামান্য গ্যাস পাওয়া যেত। রাত জেগে, কষ্ট করে বাড়ির রান্নার কাজ করতাম। কয়েক দিন ধরে দিন-রাতের কোনো সময় গ্যাস পাচ্ছি না। ইলেকট্রিক চুলায় বা সিলিন্ডার গ্যাসে রান্নার সামর্থ্য নেই।’

গ্যাসের তীব্র সংকটের কারণে এমন চিত্র এখন মুন্সিগঞ্জ জেলার সর্বত্র। গ্যাস না পাওয়ায় রান্না করতে পারছেন না তিতাস গ্যাসের গ্রাহকেরা। নিরুপায় হয়ে অনেকে মাটির চুলা, এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার এবং বৈদ্যুতিক চুলা দিয়ে রান্নার কাজ সেরে নিচ্ছেন।

গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার উত্তর ইসলামপুর, যোগনীঘাট, নয়াপাড়া, খালইস্ট, দেওভোগ, জগধাত্রীপাড়া, পঞ্চসার, দয়ালবাজার, ফিরিঙ্গিবাজার, মিরকাদিম পৌর এলাকায় সরেজমিনে ২০-২৫ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই বছরের বেশি সময় ধরে এসব এলাকার বিভিন্ন মহল্লায় গ্যাস-সংকট তীব্র থেকে তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে রান্না করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন হাজার হাজার মানুষ।

একাধিকবার বিষয়টি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তাদের জানানোর পরও এ সমস্যার সমাধান হয়নি। এক সপ্তাহ ধরে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।

বেলা ১১টার দিকে মিরকাদিম পৌরসভার কালিন্দিপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নিলুফা আক্তার নামের একজন গৃহিণী বাড়ির সামনেই মাটির চুলায় রান্না বসিয়েছেন। একটু দূরেই আরও কয়েকজন নারী মাটির চুলায় রান্না বসিয়েছেন। চুলায় রান্না করার জন্য অপেক্ষায় বসে আছেন আরও কয়েকজন নারী। নিলুফা বলেন, ‘গ্যাস–সংকট দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে। চুলায় দিন-রাতের কখনোই গ্যাস পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে কখনো গ্যাসের সিলিন্ডারে, কখনো মাটির চুলায় রান্না করি।’

বাসাবাড়িতে দিনের বেলায় একেবারেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়ে শহরের বৈখর এলাকার গৃহিণী আলেয়া আক্তার বলেন, আগে শুক্রবার অথবা বন্ধের দিন গ্যাস থাকত। এখন সেটাও নেই। অথচ নিয়মিত গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে তিতাস গ্যাসের যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের মাথাব্যথা নেই। গ্যাস দিতে না পারলে লাইন রেখে লাভ কী। উল্টো মাসে মাসে বিল গুনতে হচ্ছে। এই গৃহিণীর কথা, গ্যাস দিতে না পারলে তিতাসের লোকজন লাইন খুলে নিয়ে যাক।

তিতাস গ্যাসের মুন্সিগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৭১ লাখ ঘনমিটার গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। দুই মাস আগে ৩১ লাখ ঘনমিটার সরবরাহ ছিল। বর্তমানে ৩ লাখ সরবরাহ কমে ২৮ লাখ ঘনমিটারে এসে ঠেকেছে। আবাসিক সংযোগ আছে ১৩ হাজার ৯৫৭টি। ২৫টি শিল্প, ৪০টি বাণিজ্যিক ও ১১টি ক্যাপটিভ (বিদ্যুৎ উপাদনকারী) সংযোগ রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপক মেজবা উদ্দিন শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের উৎপাদন নেই। মুন্সিগঞ্জে চাহিদার তুলনায় অর্ধেকের কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এখান থেকেই আবার সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য গ্যাস নেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে দিন দিন গ্যাসের সংকট আরও বাড়ছে। এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। গ্যাসের বিল এড়াতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। বিষয়টি জানালে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।

দুর্নীতির কারণে গ্যাসের সরবরাহে এমন নাজুক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন মুন্সিগঞ্জ নাগরিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক সুজন হায়দার। তিনি বলেন, ‘মুন্সিগঞ্জে গ্যাসের সরবরাহ খুব কম। এর মধ্যে একটি চক্র পুরো মুন্সিগঞ্জ জেলায় অবৈধভাবে বাণিজ্যিক ও আবাসিক গ্যাস-সংযোগ দিয়েছে। এ চক্রের সঙ্গে তিতাসের কর্মকর্তারা জড়িত বলে আমি মনে করি। গ্যাস–সংকট সমাধানে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। একই সঙ্গে যেহেতু বাসাবাড়িতে গ্যাস নেই, তাই আবাসিক লাইনগুলোর বিল নেওয়া বন্ধ রাখুক।’

প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.