সকালের দিকে শুধু জোয়ারের সময় চার-পাঁচটা লঞ্চ কোনোরকমে চলে। দিনের বাকি সময় লঞ্চ বন্ধ রাখতে হয়। কমে গেছে যাত্রীও। কয়েক বছর আগেও ভোররাত থেকে লঞ্চের হর্ন বাজতে শুরু করত। লোকেলোকারণ্য হয়ে উঠত লঞ্চঘাট এলাকা। যাত্রীদের ভারী মালামাল আনা–নেওয়ার কাজে ছুটে যেতেন শ্রমিকেরা। কোলাহল থাকত ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। এমনই ছিল মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম লঞ্চঘাটের নিত্যদিনের গল্প। নাব্যতা–সংকটের কারণে এই ঘাট দিয়ে এখন নিয়মিত লঞ্চ চলে না।
১৯৮২ সাল থেকে এ লঞ্চঘাটে শ্রমিকের কাজ করেন মোকলেছুর রহমান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন বছর আগেও ছোট-বড় লঞ্চ চলাচলে ঘাট কোলাহলপূর্ণ ছিল। প্রত্যেক শ্রমিক দিনে পেতেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। নাব্যতা সমস্যার কারণে এখন লঞ্চ খুব একটা চলে না। যাত্রীও আসে না। মালবাহী ট্রলার থেকে মালামাল নামিয়ে সারা দিনে ২০০ টাকার বেশি আয় করা সম্ভব হয় না।
মিরকাদিম লঞ্চঘাট ইছামতী ও ধলেশ্বরী নদীর মোহনার ২০০ গজ পূর্বে অবস্থিত। ঘাট সূত্রে জানা যায়, একসময় তালতলা-বালিগাঁও ও মিরকাদিম লঞ্চঘাট হয়ে ৪২টি মাঝারি এবং ৩৫টি লঞ্চ ঢাকার সদরঘাটে যাতায়াত করত। নৌপথে নাব্যতা না থাকায় ১৭ বছর আগে বালিগাঁও–তালতলা ঘাট বন্ধ হয়ে যায়। তবে মিরকাদিম ঘাটটি সচল ছিল। ৫ বছর আগেও ছোট-বড় ৫০টি লঞ্চে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার যাত্রী মুন্সিগঞ্জ থেকে রাজধানী ঢাকা ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাতায়াত করতেন।
মিরকাদিম লঞ্চঘাটের অতীত তুলে ধরে ঘাটে বিআইডব্লিউটিএর পন্টুন স্টাফ মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এ ঘাটে কাজ করছেন। একসময় এই ঘাট লঞ্চ ও যাত্রীতে পূর্ণ ছিল। দিনরাত কাজ করতে হতো। কয়েক বছর ধরে ঘাটে নাব্যতা–সংকট তৈরি হয়েছে। লঞ্চ চলাচল করতে পারছে না। কমে গেছে যাত্রী। এখন বসে থেকে সময় কাটে তাঁর। ঘাটের পন্টুন বর্তমানে যে স্থানে আছে, সেখান থেকে নদীর তীরে বসানো হলে এ ঘাটের সোনালি দিন ফিরবে বলে মনে করেন মোস্তফা।
পন্টুন সরিয়ে নদীর কাছে নেওয়াকে সমাধান হিসেবে দেখছেন সংস্থাটির অতিরিক্ত প্রকৌশলী (খনন বিভাগ) সাইদুর রহমানও। তিনি
বলেন, ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর এ নৌপথ খনন করা হচ্ছে। প্রতি বর্ষা মৌসুমে পলি জমে ভরাট হয়ে যায়। পন্টুন নদীর পাড়ে নিয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি ভালো হবে।
মিরকাদিম লঞ্চঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পন্টুনের দক্ষিণ–পশ্চিম পাশের পুরোটাই শক্ত মাটির আস্তরে ভরে গেছে। দক্ষিণ পাশে বিশাল চর। উত্তর পাশে নদীতে কিছুটা পানি থাকলেও পূর্ব দিকে নতুন করে চর জাগতে শুরু করেছে। সুনসান ঘাটের এক পাশে বসে আছেন কয়েক শ্রমিক। পন্টুনে বাঁধা আছে তিনটি লঞ্চ। লঞ্চের কয়েকজন চালক, শ্রমিক ভেতরে বসে অলস সময় পার করছেন।
ঘাটে অপেক্ষমাণ রাজীব-২ লঞ্চের কেরানি প্রদীপ বাবু বলেন, ‘সকালের দিকে শুধু জোয়ারের সময় চার-পাঁচটি লঞ্চ কোনোরকম চলে। দিনের বাকি সময় লঞ্চ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তিন বছর আগে মুন্সিগঞ্জ থেকে ২০০-২৫০ যাত্রী নিয়ে ঢাকায় যাতায়াত করতাম। ঠিকমতো লঞ্চ চলাচল না করায় যাত্রীরা এখন এ ঘাটে আসেন না। ৩০-৪০ জন যাত্রীও পাওয়া যায় না।’
লঞ্চচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি লঞ্চ মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকার সদরঘাটে আসা–যাওয়া করতে সাড়ে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। নাব্যতা–সংকটের কারণে যাত্রী কমে যাওয়ায় এখন প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি আয় হয় না। প্রতি মাসেই মালিকপক্ষকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। বেতন নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ইজারাদার ও বিআইডব্লিউটিএকে জানালেও কেউ কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছেন না।
ঘাটের নাব্যতা–সংকট দূর করতে খননকাজের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক (নারায়ণগঞ্জ বন্দর) শেখ মাসুদ কামাল বলেন, ইজারাদার অথবা লঞ্চমালিক সমিতির লোকজন লিখিতভাবে জানালে পন্টুন সরানোর বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘাটের এমন দশায় হতাশা প্রকাশ করে ঘাটের ইজারাদার দিল মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাব্যতা–সংকটের কারণে যাত্রীরা লঞ্চঘাটে আসেন না। যাত্রীরা গালমন্দ করে ঘাট থেকে ফিরে যান। দিনে দিনে ঘাটে যাত্রী আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লঞ্চঘাটের ইজারা নিয়ে কয়েক কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছি।’
প্রথম আলো
Leave a Reply