মুন্সিগঞ্জে নানা কর্মসূচিতে পালিত হচ্ছে হানাদারমুক্ত দিবস

মুন্সিগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস আজ (১১ ডিসেম্বর)। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার মুক্ত হয়েছিল মুন্সিগঞ্জ। দিবসটি উপলক্ষে মুন্সিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য র্যালি ও আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এছাড়া মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলায় এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বিভিন্ন আয়োজনে শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করছে জেলাবাসী।

মুন্সিগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সহকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজউদ্দীন তালুকদার বুলু জাগো নিউজকে বলেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। আমিসহ জেলার বহু মুক্তিযোদ্ধা ভারতে চলে যাই ট্রেনিংয়ের জন্য। ফিরে এসে জেলায় বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করি। ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে জেলার ছয়টি থানার মধ্যে পাঁচটি স্বাধীন হয়। বাকি থাকে সদর থানা। ১০ ডিসেম্বর আমরা চারদিক থেকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প ঘিরে ফেলি। এরপর পাকিস্তানি কমান্ডের বরাবর একটি চিঠিতে লেখে বার্তা পাঠাই যে আমরা তিনদিক থেকে তোমাদের ঘিরে ফেলেছি। একটি দিকে খোলা আছে সেটি হলো ধলেশ্বরী নদী। পরে রাতে আমরা পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আক্রমণ করি। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আমরা বুঝতে পারি তারা মুন্সিগঞ্জ থেকে নদী পথে পালিয়েছে। ১১ ডিসেম্বর সকালে উত্তোলন করা হয় লাল সবুজের পতাকা।

জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৫ মার্চ পাক হানাদারদের আক্রমণের পর সোচ্চার হয়ে উঠে জেলার মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ। ২৭ মার্চ ছাত্র শ্রমিক-কৃষক-জনতা সিরাজদিখান থানা পুলিশ ক্যাম্পের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। ২৯ মার্চ মুন্সিগঞ্জের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় ছাত্র ও জনতা। এরপর যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলার সর্বত্র অবস্থান ও প্রতিরোধ ঘরে তোলে। তবে অনেক প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে ৯ মে পাকবাহিনী ঢুকে পড়ে মুন্সিগঞ্জে। তারা গজারিয়া থানায় আক্রমণ করে। ফুলদী নদীর তীরে ৩৬০ জেলে ও কৃষককে ব্রাশফায়ার করে হত্যার মধ্য দিয়ে মুন্সিগঞ্জে প্রবেশ করে। এরপর পাকবাহিনী মুন্সিগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজে অবস্থান নেয় এবং শান্তি বাহিনী গঠন করে। এসময়ে পাকসেনারা মুন্সিগঞ্জ শহরের বেশ কিছু বসতবাড়ি পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। একই সময়ে গজারিয়ার চর ও জেলে পল্লীতে প্রবেশ করে ২০০ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। ১৪ মে শহরের অদূরে কেওয়ার চৌধুরী বাড়িতে হানা দিয়ে ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা ও ৫০ জন মহিলাকে ধর্ষণ করে। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন ১০-১৫ জনকে ধরে নিয়ে তৎকালীন মুন্সেফ কোর্টের বটগাছে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে হানাদাররা।

এদিকে, ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলটি জুনের শেষ দিকে মুন্সিগঞ্জে ফিরে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এসময় তারা প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় ছাত্র ও যুবককে ক্যাম্প থেকে ১৫-২০ দিনের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়। এতে জেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক হয়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।

১১ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা শ্রীনগর থানায় পাক সেনাদের উপর আক্রমণ করে এবং তুমুল যুদ্ধের পর থানা দখল করে নেয়। ১৩ আগস্ট টঙ্গিবাড়ী থানার আব্দুল্লাপুর বাজারে হানা দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। সেখানে পিস কমিটির সভা চলাকালে জেলার অন্যতম স্বাধীনতা বিরোধী জামায়েত, নিজাম, ওলেমা পার্টির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি মোস্তফা আল মাদানিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা লৌহজং থানায় আক্রমণ করে তারা দখল করে নেয়। মুন্সিগঞ্জের ছয় থানার মধ্যে প্রথম মুক্ত হয় লৌহজং থানা।

১ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মুন্সিগঞ্জ শহরের শান্তি কমিটির কার্যালয়ে অভিযান চালায়। সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ৈখালীর শিকরামপুর হাটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক সেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। নবাবগঞ্জ থেকে তিনটি গানবোট বোঝাই পাকসেনারা শিকরামপুরে পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র হামলা চালায়। এ যুদ্ধে শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়। মুন্সিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশন শুরু হয় আব্দুল্লাপুর বাজার পাক সেনাদের ক্যাম্পে হামলার মধ্য দিয়ে। ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। এতে হানাদার বাহিনী পরাস্ত হয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে দুইজন পাকসেনা ও ১১ রাজাকার নিহত হয়।

এছাড়াও ২৪ সেপ্টেম্বর জেলার গোয়ালীমান্দ্রা, ২৫ সেপ্টেম্বর সিরাজদিখানের সৈয়দপুর লঞ্চঘাটসহ ধলাগাও, সাধুর আখড়া ও টঙ্গিবাড়ী, ধলাঁগাও বাজারে। কয়েকটি সফল অপারেশন চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। ধারাবাহিকভাবে ১৫ নভেম্বর টঙ্গিবাড়ী, ১৭ নভেম্বর শ্রীনগর, ২০ নভেম্বর সিরাজদিখান ও ১০ ডিসেম্বর গজারিয়া থানা স্বাধীন হয়।

৪ ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ হয় শহর সংলগ্ন রতনপুর এলাকায়। এ যুদ্ধে বিভিন্ন এলাকা থেকে সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা পাক সেনাদের তিনটি বড় দলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পাকসেনারা ধলেশ্বরী নদীতে থাকা গানবোট থেকে মর্টার সেলিং করছিল। এ সময় মিত্র বাহিনীর বিমান বহর এসে পড়লে পাকসেনারা পিছু হটে। পরে মিত্র বাহিনীর আক্রমণে পাকসেনাদের গানবোট বিধ্বস্ত হয়। এসময় তিনজন পাকসেনাসহ ১৪-১৫ জন নিরীহ মানুষ মারা যায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার আন্দোলনের মুখে ১০ ডিসেম্বর দিনগত রাত ৩টার দিকে মুন্সিগঞ্জ থেকে নদী পথে পালিয়ে যায় হানাদাররা। ১১ ডিসেম্বর বিজয় উল্লাসে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে মুন্সিগঞ্জবাসী। মুক্ত হয় মুন্সিগঞ্জ।

আরাফাত রায়হান সাকিব/জেএস/এমএস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.