কাজের সন্ধানে মুন্সিগঞ্জের শ্রমের হাটে শত শত শ্রমিক

গ্রামে ঠিকমতো কাজ পাওয়া যায় না। মজুরিও কম। তাই পরিবারের অভাব-অনটন মেটাতে কাজের সন্ধানে নিজের জেলা ছেড়ে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর বালিগাঁও বাজারে জড়ো হন অনেক শ্রমিক। এ থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালান তাঁরা।

এমন এক শ্রমিক সুভাষিণী। তিনি কুড়িগ্রামের বাসিন্দা। কাজ খুঁজতে স্বামী-সন্তানসহ তিনি এক মাস ধরে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীর শ্রমের হাটে আসেন। শুধু সুভাষিণী নন, তাঁর মতো এমন সাত থেকে আট শ নারী ও পুরুষ শ্রমিক রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে আসেন কাজের সন্ধানে।

সুভাষিণী বলেন, ছয় বছর ধরে এই হাটে তাঁরা শ্রম বিক্রির জন্য আসেন। কৃষিজমি পরিষ্কার, আলু লাগানোসহ দিন চুক্তিতে সব ধরনের কৃষিকাজ করেন তাঁরা। ছয় মাস চলে তাঁদের কাজ। যে টাকা আয় হয়, সেটা দিয়ে সারা বছর সংসার চালান তাঁরা।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে মুন্সিগঞ্জ আলুর জন্য নাম করেছে। প্রতিবছর কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলুর আবাদ টঙ্গিবাড়ী উপজেলায়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আলু আবাদ ও উত্তোলন করতে হয়। এ জন্য অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। তবে মুন্সিগঞ্জে চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের সংখ্যা ছিল কম। আর উত্তরাঞ্চলের মানুষের ছিল কাজের অভাব। ২০ বছর আগে চাহিদা ও জোগানের একটা সমন্বয় হয়। উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকেরা এদিকে আসতে শুরু করেন শ্রম বিক্রির জন্য। প্রথম দিকে ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রমিক এখানে আসতেন। পরে এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১০ বছর আগে এই সংখ্যা বেড়ে দুই থেকে তিন হাজার হয়ে যায়। তবে কৃষিজমি ও কাজ কমতে শুরু করায় হাটে শ্রমিক আসা কমে গেছে। এখন সাত থেকে আট শ শ্রমিক প্রতিদিন এখানে শ্রম বিক্রি করতে আসেন।

বালিগাঁওয়ের অদূরেই আউটশাহী ইউনিয়ন। সেই ইউনিয়নের বরুন্ডা গ্রাম থেকে শ্রমিক নিতে এসেছেন আলী আজগর। তিনি বলেন, আলুর জমি প্রস্তুত করার জন্য ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক দরকার। একসঙ্গে এত শ্রমিক শুধু এই হাটেই পাওয়া যায়। দিনপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পারিশ্রমিকে একেকজন শ্রমিক পাওয়া যায়। তাই ১০ বছর ধরে ৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই হাটে এসে শ্রমিক নিয়ে যান তিনি।

আজ বুধবার ভোরে বালিগাঁও বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাজারের সামনে মুন্সিগঞ্জ-বালিগাঁও-লৌহজং সড়কের দুই পাশে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ জন শ্রমিক সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী। স্থানীয় কৃষকেরা এসব শ্রমিকদের মধ্য থেকে দরদাম করে জমির কাজের জন্য শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক শ্রমিক দিন চুক্তিতে কাঙ্ক্ষিত মূল্যে কাজ করতে দর–কষাকষি করছেন।

কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর নভেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত তাঁদের কাজের চাহিদা থাকে। এই সময় তাঁরা বালিগাঁও ও আশপাশের খুপরি, স্কুলের বারান্দা, নদীর পাড়ে অস্থায়ী বসতি করে থাকেন। আলুর জমি প্রস্তুত, আলু লাগানো ও আলু তোলার কাজ শেষ করে মুন্সিগঞ্জ থেকে চলে যান।

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মঞ্জু রানী বলেন, ‘সবকিছুর দাম বেশি। পেটের দায়ে কাজ করতে মুন্সিগঞ্জে এসেছি। এখানেও কাজের চাহিদা কমে গেছে। গত বছর দিনভিত্তিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পেলেও এবার ৩০০ টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।’

গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর এলাকার বাসিন্দা রাসেল। সস্ত্রীক বালিগাঁওয়ে কাজের সন্ধানে এসেছেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগে তাঁরা শ্রম বিক্রির হাটে এসে বসে থাকেন। কখনো কাজ পান, কখনো পান না।

প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.