তবু রাসায়নিকের সঙ্গেই বাস পুরান ঢাকাবাসীর

গত এক বছরে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আগুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার নাজিরাবাজার এলাকার আলুবাজারে একটি জুতার কারখানায় আগুন লাগে। এতে ঘটনাস্থলের আশপাশে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ায়। আগুনে অন্তত পাঁচ লাখ টাকার মালপত্র পুড়েছে।

শুধু এই কারখানাতেই নয়, গত ১২ বছরে পুরান ঢাকায় ছোট-বড় কারখানা ও বাসাবাড়িতে তিন শতাধিক ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ছিল অনেক মানুষের পুড়ে মারা যাওয়ার দুটি বড় দুর্ঘটনা। তা সত্ত্বেও পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে সরে যায়নি রাসায়নিকের গুদাম। ঢাকার বাইরে নিরাপদ স্থানে কেমিক্যালপল্লী গড়ার কাজ চলছে ঢিমে তালে। অস্থায়ী স্থানে গুদাম সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগও চাপা পড়ে আছে।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের আগুনে পরিবারের ১১ সদস্যকে হারানো মো. গোলাম এলাহি বলেন, রাসায়নিকের আগুনের ঘটনায় অনেক মানুষ পুড়ে মরেছে। এর পরও এখনো কেন এ এলাকা রাসায়নিকমুক্ত হলো না, এটাই আফসোস। তাই সব সময়ই মনের মধ্য প্রশ্ন জাগে, আর কত মানুষ পুড়ে মরলে রাষ্ট্রের টনক নড়বে?’

গতকাল সোমবার সরেজমিনে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে পুরান ঢাকার রাসায়নিকের আগুন নিয়ে তাদের ক্ষোভ আর আতঙ্কের কথা জানা যায়। তারা বলে, ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলী ট্র্যাজেডিতে নারী, শিশুসহ ১২৫ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। এ ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের দোকান ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার জোরালো দাবি ওঠে। সরকারও এ নিয়ে সময় বেঁধে দিয়েছিল। তবে আজও তা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

এলাকাবাসী জানায়, নিমতলীর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টায় বড় আগুনে প্রাণহানির সংখ্যা ৭১। এ দুটি অগ্নিকাণ্ডের উৎস রাসায়নিকের গুদাম। এর মধ্যে আরো অন্তত অর্ধশত আগুনের ঘটনা এলাকাবাসীর মনে দাগ কেটে আছে। তবু সেই রাসায়নিকের সঙ্গেই বাস করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয়রা। একজন বলেন, ‘ফের পুরান ঢাকাকে মৃত্যুপুরী না বানাতে চাইলে এখনো সময় আছে রাসায়নিকের গুদাম সরানোর। ’

জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে রাসায়নিক পদার্থ থেকে সৃষ্ট আগুনের পর টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী অবিলম্বে রাসায়নিকের কারখানাগুলো সরিয়ে আবাসিক এলাকা নিরাপদ করার কথা বলা হয়। অথচ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি সরকারি প্রতিশ্রুতি।

এসব দুর্ঘটনা রোধসহ আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিল সরকার। তবে সরকারের সেই ইচ্ছা এখনো বাস্তবে রূপ পায়নি।

২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লী, ঢাকা’ নামে একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায়। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। পরে ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় আবারও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এতে আবার টনক নড়ে সবার। কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে তখন নতুন স্থান ঠিক হয় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান। এরপর প্রকল্পটিও সংশোধন হয় চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর। শুরুতে এ প্রকল্প ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে সময় বাড়িয়ে করা হয় ২০২২ সালের জুন। শুধু সময়ই বাড়েনি, নাম পরিবর্তন হয়ে এটি ‘বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সীগঞ্জ’ হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়েছে আট গুণ। প্রথমে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। সংশোধনের পর এই প্রকল্পের ব্যয় পাঁচ গুণ বেড়ে নির্ধারিত হয়েছে এক হাজার ৬১৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

ঢাকার কেরানীগঞ্জে ৫০ একর জমিতে হওয়ার কথা থাকলেও মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার তুলসীখালী ব্রিজসংলগ্ন গোয়ালিয়া, চিত্রকোট ও কামারকান্দা নামক তিনটি মৌজার মোট ৩১০ একর জমির ওপর দুই হাজার ১৫৪টি শিল্প প্লট তৈরির কথা রয়েছে।

প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে শিল্প মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দুই বছর চলে গেছে শুধু জমি অধিগ্রহণেই। এখনো মাটি ফেলে সেই জায়গা ও অবকাঠামো নির্মাণ উপযোগী করে তুলতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।

জানা যায়, নিমতলী আগুনের ঘটনায় পুরান ঢাকায় অভিযানে প্রায় এক হাজার রাসায়নিক পদার্থের গুদাম বা কারখানার মধ্যে লাইসেন্স পাওয়া যায় মাত্র ১২৭টির। এমন তথ্য দিয়ে এই বৈধ-অবৈধ প্রতিষ্ঠাগুলো সে সময় এক মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত টাস্কফোর্স।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদাম ও দোকান রয়েছে প্রায় ২২ হাজার। অনুমোদন বা লাইসেন্স আছে মাত্র ৮০০টি গুদামের। বিভিন্ন বাসাবাড়িতেও আছে কেমিক্যাল ও পারফিউমের গুদাম।

স্থানীয়রা বলছে, নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো ভয়াবহ ঘটনার পরও রাসায়নিক পদার্থের ঝুঁকি থেকে বের হতে পারেনি এলাকাবাসী। নিমতলীর পর চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডে পুরান ঢাকা থেকে সব কেমিক্যাল গুদাম ও দোকান সরানোর ঘোষণা দিয়েছিল একাধিক মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। ঘোষণা বাস্তবায়নে ১৫ দিনের অভিযান চালিয়েছিল সিটি করপোরেশন। কয়েকটি গুদাম সিলগালাও করা হয়েছিল। তবে বিশেষ পরিবর্তন আসেনি তাতে। প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে রাসায়নিকের কেনাবেচা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

কালের কন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.