বাবু এবং টাপুদের মতন অসভ্য মানুষ, সভ্য সমাজে এদের পদচারনা কাম্য হতে পারে না।

জাপানে আমার বসবাস করার বয়স অন্যান্যদের মতো অতোটা না হলেও একেবারেই যে কম তাও নয় । প্রায় দুই যুগ হ’তে চলেছে । তবে নাতিদীর্ঘ এই সময়ে প্রবাস জীবনের যে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়েছে তাও একেবারে কম নয় । স্বামী জাপান থাকার সুবাদে আমার জাপান আসা ।

জাপান আসার পর দেখেছি , জাপান প্রবাসীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতে অনেক অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছে ।

তার অন্যতম প্রধান কারন ছিল জাপান প্রবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ । দেশের স্বার্থে সবাই যার যার রাজনৈতিক অবস্থান ভুলে গিয়ে এক টেবিলে বসতে দেখেছি । এখানে আওয়ামীলীগ , বিএনপি বা অন্যান্য সব রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে । এখানে প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে দলীয় কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে স্থানীয় জাপানী আইনের প্রতি শ্রদ্ধ্বা রেখে । তারপর ও তারা দেশের প্রয়োজনে একযোগে কাজ করেছে ।

যার ফলশ্রুতিতে দেশের বাহিরে এই জাপানে সরকারী অর্থায়নে প্রথম স্থায়ী (টোকিও) শহীদ মিনার নির্মাণ , সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বৈশাখী মেলা উদযাপন , ধর্ম বর্ণ ,দলমত নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতায় মহান শহীদ দিবস , স্বাধীনতা দিবস , বিজয় দিবস, দ্বিতীয় প্রজন্মের শিশুকিশোরদের নিয়ে প্রতি বছর অনুষ্ঠান আয়োজন সম্ভব হচ্ছে । এটা বাঙ্গালী সংস্কৃতির একটা অংশ ।

১১ ডিসেম্বর ২০২২ টোকিও টাওয়ারের ২য় তলায় সিদ্দিক রেস্টুরেন্ট স্বপরিবারে যোগ দিয়েছিলাম একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে ।

আমার মতো আরও অনেক দম্পতি এসেছিলেন তাদের সন্তানদের নিয়ে ।।

আয়োজনটি ছিল জাপানে বহুল পরিচিত মুখ স্বপন বেপারীর বিবাহত্তোর সংবর্ধনা । সান্ধ্যকালীন এ আয়োজনে প্রথম থেকেই আমরা ছিলাম । বলা যায় স্বপরিবারে আমরাই প্রথম। ধীরে ধীরে লোক সমাগম শুরু হতে থাকে । ইতোমধ্যে কয়েকজন নিজেদের মতো করে বিয়ার পান করা শুরু করে দেন । যদিও আপ্যায়নের ম্যানুতে এলকোহল সরবরাহের অনুমতি ছিলনা। তারপরও অভ্যাসবশত তারা বিয়ার পান করে যাচ্ছিলেন ।

তারা তাদের নিজস্ব অর্থায়নে বিয়ার পান করছিলেন তাই ইচ্ছে থাকলে বলার কিছু ছিল না । ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের সামনে তাদের আঙ্কেলরা বিয়ার তথা এলকোহল বা মদ পান করছে এটা আমাকে পীড়া দিচ্ছিল ।

তার অন্যতম কারন ,জাপানে বসবাস করলেও সন্তানদের নিজ ধর্মীয় এবং নিজ দেশীয় সংস্কৃতির ব্রত নিয়েই বড় করার চেষ্টারত এই আমি । তাই মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল । আবার অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগও করতে পারছিলাম না পাছে দায়িত্ব পালনে অবহেলা হয় বলে । তাই , অস্বস্তি থাকলেও সন্তানদের হৈ-হল্লা দেখে এবং পারিবারিক শিক্ষা থেকে চালিয়ে যাচ্ছিলাম সবার সাথে কুশল বিনিময় করে ।

হটাৎ ঈশানকোণ থেকে হট্টগলের আওয়াজ এলে চোখ এবং কান চলে যায় সেখানে । যদিও দেহটা নিজ আসনেই ছিল । আঙ্কেলদের উচ্চস্বরে এই অশ্রাব্য বাক্য প্রয়োগ এবং শারীরিক ভাষা শিশুদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি করে । সবাই আমার সাথে একমত হবেন যে , জাপানে বেড়ে উঠা শিশুরা বাংলাদেশের মতো অভিভাবক বা সমপর্যায়ের কারোর উচ্চস্বর বা ঝগড়াঝাঁটি দেখে অভ্যস্ত নয়। তাই তারা বুঝে উঠতে পারছিল না কি ঘটতে চলেছে ।

দুঃখজনক ভাবে মদারুদের বসার টেবিলটি ছিল আমাদের বসার টেবিলের পার্শ্বেই । প্রথম থেকেই আব্দুল হাই টাপু এবং খান বাবু (এর আগে কোন অনুষ্ঠানে দেখছি বলে মনে করতে পারছিনা , পরে তাদের নাম , পরিচয় এবং তাদের সম্পর্কে জেনেছি ) একের পর এক বিয়ার পান করেই যাচ্ছিলেন এবং অসংসগ্ন সব কথা বলে যাচ্ছিলেন।

আয়োজনে ডিনারের আহবান জানালে প্রথমেই তারা লাইনে দাঁড়ান এবং নেয়া শুরু করেন । বিভিন্ন খাবার সংগ্রহের পর বিফ কারির জন্য চিৎকার চেচামেচি শুরু কেরেন এবং এক পর্যায়ে খাবার সরবরাহকারীদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েন ।

একটি ঘরোয়া সামাজিক অনুষ্ঠানে বিষয়টি শোভনীয় নয় বিধায় সংযম দেখানোর অনুরোধ জানান আয়োজকদের পক্ষে স্বপন বেপারী এবং এমডি এস ইসলাম নান্নু । আর অমনি এলকোহল-এর সমস্ত প্রতিক্রিয়া এসে পড়ে জনাব নান্নুর উপর ।

টাপু এবং বাবু কর্তৃক অত্যন্ত অভদ্র , অশ্রাব্য এবং অশালীন ভাষায় গালিগালাজ এবং একই সাথে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন উপস্থিত সবাইকে হতভম্ব করে দেয় । শিশুরা সব আতঙ্কে যার যার মায়ের কাছে চলে যায় । যদিও বেশ কয়েকজন তাদের নিভৃত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তবুও তারা কিছুতেই নিভৃত হচ্ছিলেন না । এক পর্যায় রেস্টুরেন্ট এর আসবাবপত্র ভাংচুরে লিপ্ত হন । এ যেন বাংলা সিনেমায় ভিলেন কর্তৃক তান্ডব এর কোন দৃশ্যের শুটিং। এটা যে জাপান এ কথাটি যেন ভুলেই গেছেন ।

যতদূর জানা যায় তাদের উভয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ত্যাগ করে জাপানি পাসপোর্ট নিয়েছেন ।

তা তারা নিতেই পারেন । কিন্তু তাই বলে কি বাংলাদেশী নাগরিক, বাঙ্গালী সমাজ এবং বাংলা সংস্কৃতিকে অপমান করতে হবে , দূরে ঠেলে দিতে হবে ? কিংবা ছোট করতে হবে ।

মনে রাখতে হবে, উক্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে শুধু বাংলাদেশীরাই আমন্ত্রিত ছিলেন না। আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলেন , জাপানি , পাকিস্তানী সহ অন্যান্য দেশের অতিথিরাও। তাদের উপস্থিতিতে এমন ঘটনা সবাইকে শুধু হতবাকই করেননি, রীতিমতো নির্বাক করে দেয় ।
আমি নিজেও কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যাই । কি করা উচিৎ ভেবে পাচ্ছিলাম না। পাশে তাকিয়ে দেখলাম অন্যান্য মায়েরাও আমারই মতো নিজ নিজ সন্তানদের আগলে রাখছেন ।

জাপানের মতো দেশে মদপান আইনগত কিংবা সামাজিকতায় কোন অপরাধ নয় । জাপানিরাও প্রচুর মদপান করে । অনেক বাংলাদেশীদেরও মদ পান করেন। তারা মদপান করেন , মদ তাদের পান করে না।

কিন্তু ১১ ডিসেম্বরের ঘটনায় মনে হয়েছে মদ শুধু তাদের পান-ই করেনি , সর্বাঙ্গ খেয়ে মানুষরুপী এদের কে অমানুষ করে ফেলেছে । এদের দেখে পুরনো একটি গ্রাম্য চরণ মনে পরে গেছে –

“ গাজায় গোলাপ রঙ
ভাং রঙ ভূতিয়া ,
তারিতে রঙের রঙ
মদ খায় (পান) চুতিয়া” ।

জাপানীরা মদ পান করে কারনে , অকারনে । কিন্তু মদপান করে অশ্লীল ,আশ্রাব্য, অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে কয়জনা ? ভাংচুরই বা ক’জনায় ? বিশেষ করে পারিবারিক, সামাজিক আয়োজনে । যেখানে শিশুদের উপস্থিতি থাকে ।

আমরা কি ভুলে যাচ্ছি যে, আমরা যে দেশে বা যে সমাজেই বাস করিনা কেন আমাদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি রয়েছে যা হাজার বছরের পুরনো, সমৃদ্ধ এবং ঐতিহ্যে ভরপুর । সেই সংস্কৃতি ধারন এবং লালন করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। ধর্মীয় কথা না হয় বাদই দিলাম।

সংস্কৃতি মানুষের জীবনধারার প্রতিফলন । সংস্কৃতির কারনেই মানুষের ব্যক্তি জীবন এবং সমাজ জীবন অন্যদের থেকে স্বতন্ত্রতা পায়। পৃথিবীর প্রত্যেক সমাজেরই নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। প্রতিটি সংস্কৃতিরই আলাদা বৈশিষ্ট রয়েছে । মুলত প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিন্নতা এবং এর সাথে খাপ খাওয়ানোর ভিন্ন ভিন্ন কৌশল ও উপকরণের কারনে সমাজের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট নিজস্ব হয়ে থাকে ।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিও এর বাইরে নয় । এ সংস্কৃতির রয়েছে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট বা উপাদান যা এটিকে অন্য সংস্কৃতি থেকে পৃথক করেছে । সংস্কৃতির এ সকল উপাদানের মধ্যে রয়েছে ভাষা , চিন্তা ,বুদ্ধি, জ্ঞান, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, আচার -আচরণ ইত্যাদি।

১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় টাপু-বাবুদের কান্ডকারখানায় বাঙ্গালী চিন্তা ,বুদ্ধি, জ্ঞান, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, আচার -আচরণ-এর লেশ মাত্র ছিল না । ছিলনা জাপানি ম্যানারও । জাপানী ম্যানার হচ্ছে বিশ্ব সেরা ।

ধর্মীয় চিন্তায় জাপানি সংস্কৃতিতে আমাদের আপত্তিমূলক কিছু থাকলেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই সংস্কৃতি অনুকরণীয় অনেক কিছু রয়েছে যা রপ্ত করলে আমাদের ভাল বৈ মন্দ হওয়ার নয়।

তাহলে টাপু-বাবুরা কোন সংস্কৃতির ধারক-বাহক ? মিশ্র সংস্কৃতির ?

তা যা ইচ্ছা তারা করতেই পারেন । কিন্তু তা সম্পূর্ণই তাদের নিজস্ব ঘরোনায় । সুস্থ্য সংস্কৃতির সামাজিক আয়োজনে নয় । কারন , বন্যরা বনেই সাচ্ছন্দে থাকতে পারে । সভ্য সমাজে নয় ।

তাই , সভ্য সমাজে এদের পদচারনা কাম্য হতে পারে না।

ফারজানা ইসলাম
জাপান প্রবাসী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.