বেহাল দশায় ঐতিহ্যবাহী বাবা আদম মসজিদ

ভবতোষ চৌধুরী নুপুর: মুন্সীগঞ্জে সুফি সাধক বাবা আদম শহীদ হওয়ার প্রায় ৩০০ বছর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ১৪৭৯ সালে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন আবু জাফর শাহের পুত্র বিক্রমপুরের শাসক মহান মালিক কাফুর শাহ্ ছয়গম্বুজ বিশিষ্ট একটি কারুকার্য খচিত নয়নাভিরাম মসজিদ নির্মাণ করেন। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক মসজিদটির এখন জীর্ণ দশা। স্থানীয়দের দাবি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উচিৎ দ্রুত এটি সংরক্ষণ করা।

মসজিদের ইতিহাস জানতে ফিরতে হবে ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকে। সে সময় বাবা আদম নামে ছিলেন একজন সুফি সাধক। ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফে ১০৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর সাহচর্য পেতে ইরাকের বাগদাদে আসেন। ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ১১৫২ সালে ১২ জন আউলিয়া নিয়ে মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমের দরগাবাড়ি এলাকায় আসেন। ১১৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের রাজা বল্লাল সেনের হাতে প্রাণ দিতে হয় তাকে।

বাবা আদম শহীদ হওয়ার প্রায় ৩০০ বছর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন আবু জাফর শাহের পুত্র বিক্রমপুরের শাসক মহান মালিক কাফুর শাহ্ ছয়গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তার মাজারের পশ্চিম-উত্তর পাশে ১৪৭৯ সালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৪৮৩ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। সেই থেকে ৫শ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে এই মসজিদটি। তবে সংস্কারের অভাবে অনেকটাই ম্লান ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি।

শাহ হুমায়ুন কবির ‘The Battle of Kanai Changue’ গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়, ১১৫২ খ্রিস্টাব্দে মুন্সীগঞ্জ সদরের প্রাচীন রামপালনগরে ধর্ম প্রচারের জন্য বাবা আদম শহীদদের আগমন। তিনি মুন্সীগঞ্জ এলাকার কপালদুয়ার, মানিকেশ্বর ও ধীপুরে তিনটি খানকাহ নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার করেন।

স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি আছে, বল্লাল সেন ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারি এক শাসক। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হয়ে স্থানীয় মসজিদে আজান দেওয়া ও গরু জবাই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাবা আদম শহীদ এতে দমবার পাত্র ছিলেন না। তিনি প্রতিবাদ করেন। এবং পরবর্তী ১১৭৮ সালে বিক্রমপুরের কালাইচং ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধ ১৫ দিন স্থায়ী হয়েছিল। যুদ্ধের প্রথম ১৪ দিন জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়নি। শেষ দিন রাজা বল্লাল সেন নিজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধে বল্লাল সেন পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা করেন। তিনি বিপুল মুসলমান বাহিনী দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যান এবং যুদ্ধে পরাজয়ের আশঙ্কায় বল্লাল সেন ২০ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করেন। এবং বাবা আদম শহীদ সরল বিশ্বাসে তা মেনে নেন। কিন্তু সেই রাতেই ঘটে বিশ্বাসঘাতকতা। দরগাহ বাড়িতে এশার নামাজের পর বাবা আদম শহীদ মোরাকাবা থাকা অবস্থায় বল্লাল সেন তার তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করেন।

বাবা আদম মসজিদ (খতিব) মাওলানা মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রায় ৫৩৯ বছর আগে মুন্সীগঞ্জ সদরের দরগাবাড়ি এলাকায় অবস্থিত বাবা আদম মসজিদটি ১৪৮৩ সালে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি মালিক কাফুর নির্মাণ করেন। শহীদ বাবা আদমকে মিরকাদিমের দরগাবাড়িতে দাফনের পর তার মাজারের পাশে নির্মাণ করা হয় এই মসজিদ। এটি ছিল তার মৃত্যুর ৩১৯ বছর পরের ঘটনা।

বাবা আদম মসজিদ (সদস্য) মোহাম্মদ হোসেন রেনু ঢাকা মেইলকে বলেন, বাবা আদমের নামে নির্মিত এ মসজিদটি দেখতে বছরজুড়ে দরগাবাড়িতে দেশ-বিদেশে থেকে পর্যটক ও দর্শনার্থীরা আসেন। তবে পর্যটকদের আকর্ষণ ধরে রাখা কিংবা কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা এ স্থাপনাটি সংরক্ষণে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উচিৎ দ্রুত এটি সংরক্ষণ করা।

মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে চার কিলোমিটার পথ পেরুলেই বাবা আদম মসজিদ। আর ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে সড়কপথে মসজিদের দূরত্ব মাত্র ২৮ কিলোমিটার। সদরঘাট থেকে নৌপথে মিরকাদিম লঞ্চঘাটে নামার পর আধা কিলোমিটারের মধ্যেই ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি।

ছয় গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের নির্মাণশৈলী মনোমুগ্ধকর। এটি দৈর্ঘ্যে ৪৩ ফুট ও প্রস্থে ৩৬ ফুট। দেওয়াল প্রায় চার ফুট চওড়া। ভেতরে ইট-সুরকির গাঁথুনি। নির্মাণ নকশা বা স্থাপত্যকলা অনুযায়ী মসজিদ ভবনটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। সম্মুখের দিকে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। দুই পাশে সম আকারের দুটি জানালা। মসজিদের সামনে ওপরের দিকে রয়েছে ফারসি ভাষায় খোদাই করা কালো পাথরের ফলক।

মসজিদের ভেতরে ঢুকে সামনে গেলে চার কোনায় চারটি ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভ চোখে পড়ে। মসজিদের খিলান, দরজা, স্তম্ভের পাদদেশ, মেঝে ও ছাদের কার্নিশের নিচে ইট কেটে মুসলিম স্থাপত্যকলার অপূর্ব নকশাও লক্ষ করা যায়।

ঢাকা মেইল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.