খাল ভরাট করে ঘরবাড়ি

খালটি ব্রিটিশ শাসন আমলের। একসময় চওড়া ছিল ২৫-৩০ ফুট। ১০-১২ বছর আগে এ খাল দিয়ে চলত নৌকা।
খালটি দিয়ে একসময় নৌকা চলত। বর্ষা মৌসুমে জোয়ার-ভাটার পানি আসত। পানির সঙ্গে পলি এসে বাড়াত জমির উর্বরতা। এ খাল বেয়েই সরত আশপাশ এলাকার বৃষ্টির পানি। তবে কয়েক বছর ধরে স্থানীয় ব্যক্তিরা খাল দখল করে ভরাট করে ফেলেছেন। কোথাও কোথাও খালটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যেখানে–সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িঘর ও রাস্তা। খালটি মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার দেওভোগ ও শিলমন্দি মৌজায় অবস্থিত।

মুন্সিগঞ্জ পৌরসভা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খালটি মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার দেওভোগ মৌজার আরএস ম্যাপে ২৯৩ ও শিলমন্দি মৌজার আরএস ম্যাপে ২৯২ দাগের মধ্যে অবস্থিত। তবে মৌজা দুটির সিএস ও এসএ পরচায় ব্যক্তি মালিক। খালটি কাটাখালী নামে অন্য একটি খাল থেকে উৎপত্তি হয়ে উত্তর দিকের দেওভোগ মৌজা হয়ে শিলমন্দি মৌজায় এসে মিশেছে। সেখান থেকে মুন্সিগঞ্জ মৎস্য কার্যালয়ের দিকে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় আবুল হোসেন, নজরুল ইসলাম, হারুন অর রশিদ গাজী, ইউসুব আলী হাওলাদার, মফিজল হক হালদার, ইয়াসিন মাদবর, গোলাম নবীন নামে কয়েকজন খালটি ভরাট করে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে হারুন অর রশিদ গাজী, নজরুল ইসলামসহ কয়েকজন পৈতৃক সম্পদের সঙ্গে খালও বিক্রি করে দিয়েছেন।

এ খাল আমি একা নই, অসংখ্য মানুষ দখল করেছে। খালটি নাল হয়ে গেছে। কেউ কেউ নামজারি করে বিক্রিও করে দিয়েছেন।
আবুল হোসেন, খালে দেয়াল নির্মাণ করা বাসিন্দা

সরেজমিনে দেখা যায়, দেওভোগ অংশে খালের অস্তিত্ব চোখে পড়ে। তবে দুই পাশে ভরাটের কারণে ২৫-৩০ ফুট চওড়া খালটি এখন ১০-১৫ ফুট নালায় পরিণত হয়েছে। তবে শিলমন্দি মৌজার সবটুকু খাল একেবারেই দখল হয়ে গেছে। কোনো কোনো অংশে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর।

দুই মৌজার সংযোগস্থলে আবুল হোসেন খাল ভরাট করে দেয়াল নির্মাণ করেছেন। খাল দখলের বিষয়ে আবুল হোসেন বলেন, ‘এটি শুধু আরএসএ খাল ছিল। এ খাল আমি একা নই, অসংখ্য মানুষ দখল করেছে। খালটি নাল হয়ে গেছে। কেউ কেউ নামজারি করে বিক্রিও করে দিয়েছেন। সরকার যদি সবারটা উচ্ছেদ করে আমিও ছেড়ে দেব।’

আবুল হোসেনের দখল থেকে সীমানা ধরে উত্তর দিকে এগোতেই দেখা গেল ভরাট করা খালের ওপরেই প্রয়াত ইউসুব আলী হাওলাদার ও তাঁর ভাইদের বাড়ি। ইউসুবের স্ত্রী পরিচয়ে এক নারী বলেন, ছয়-সাত বছর ধরে তাঁরা এখানে বাড়ি করে থাকছেন। বাড়ির জায়গা তাঁর স্বামী পৈতৃকভাবে পেয়েছেন।

শাহ আলম নামে আরও এক ব্যক্তি খালের জায়গা দখল করে বহুতল পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন। তাঁর দাবি, বাড়ির জায়গা হারুন অর রশিদের কাছ থেকে জমি কিনেছেন। পরে সেখানে দালান বাড়ি করেছেন।

স্থানীয় লোকজন জানান, খালটি ব্রিটিশ শাসন আমলের। ২৫-৩০ ফুট চওড়া খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার। ১০-১২ বছর আগে এ খাল দিয়ে নৌকা চলত। এ খাল দিয়ে দেওভোগ, শিলমন্দি, কাটাখালী ও মুন্সিরহাট এলাকায় নৌকায় করে যাতায়াত করা যেত। বর্তমানে দেওভোগ মৌজায় নালার মতো খালের একটি অংশ আছে। শিলমন্দি এলাকায় খালটি প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে।

মুন্সিগঞ্জ পৌরসভা ভূমি কর্মকর্তা আবদুল ওয়াহেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি দৃশ্যমান খাল ছিল। আরএস ম্যাপেও খাল আছে। তবে এটি রেকর্ডিওভাবে মালিকানা সম্পদ। হয়তো এ বলে আগের ভূমি কর্মকর্তা নামজারি দিয়েছেন। তবে কীভাবে এটি ম্যাপে খাল হওয়া সত্ত্বেও নাল হলো এটি আমার জানা নেই।’

খালটি দখল হওয়ায় শিলমন্দি ও দেওভোগ এলাকার অন্তত ২০০ একর তিন ফসলি কৃষিজমিতে চাষাবাদ করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কৃষকেরা। খাল রক্ষায় ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেন স্থানীয় শতাধিক কৃষক। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) স্নেহাশীষ দাশ প্রথম আলোকে বলেন, খালটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খালটির প্রসঙ্গ তুলতেই দেওভোগ এলাকার কৃষক আব্দুস সাত্তার মুন্সি বলেন, ‘খালের বিভিন্ন অংশ দখল হওয়ায় বৃষ্টির পানি নামতে পারে না। এতে আবাদ করা কৃষিপণ্য নষ্ট হয়।’

শিলমান্দি এলাকার আলমগীর মোল্লা বলেন, ‘দুই বছর আগেও নিয়মিত শিলমন্দির চকে (মাঠে) সাড়ে চার একর জমিতে আলু আবাদ করতাম। খাল ভরাট হওয়ায় পানিনিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বাধ্য হয়ে জমির চাষাবাদ ছেড়ে দিয়েছি।’

নদী বাঁচাও ও পরিবেশ আন্দোলন মুন্সিগঞ্জ শাখার সভাপতি মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, খাসজমি, খাল দখল এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.