মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে কেমিক্যাল পল্লী নির্মাণের কাজ এখনও শেষ হয়নি। কাজের অগ্রগতি হয়নি আশানুরূপ। এখনও সেখানে চলছে বালু ভরাটের কাজ। ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষে কবে নাগাদ প্লট তৈরি করে তা ব্যবসায়ীদের কাছে হস্তান্তর করা হবে তারও কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। এ অবস্থায় রাজধানীর পুরান ঢাকা থেকে ক্যামিকেলের গোডাউন সরাতে আরও দুই বছর লেগে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
জানা গেছে, প্রথমেই রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জে ২০১৮ সালে নেওয়া প্রকল্পটি ২০২১ সালে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারিত থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের তুলশিখালি এলাকায় বিসিক কেমিক্যাল শিল্প পার্ক তৈরির প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয় মুন্সীগঞ্জ বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক সংশোধিত প্রকল্প। প্রক্রিয়া শুরুর পর প্রায় চার বছর সময় কেটে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে নেওয়া প্রকল্পটি ২০২১ সালে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারিত থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। পরে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হলেও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩ জুন তারিখে সংঘটিত পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদামে বিস্ফোরণে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় অনেকে। সম্পদেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাধারণ অগ্নিকাণ্ড বিস্ফোরণে রূপ নেয় রাসায়নিক দ্রব্যের কারণে। এর পরপরই রাজধানীর পুরান ঢাকায় ঘিঞ্জি অলিগলি থেকে সরিয়ে রাজধানীর কেরানীগঞ্জে ক্যামিকেল পল্লী নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ সেভাবে এগোয়নি। এরই মধ্যে ২০১৯ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আবারও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। এবারও রাজধানীর ঘিঞ্জি এলাকা থেকে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম সরিয়ে নিতে তোড়জোড় শুরু হয়। নেওয়া হয় স্থায়ী কেমিক্যাল পল্লী গঠনের উদ্যোগ। তবে এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পের তেমন কোনও অগ্রগতি নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঘনবসতিপূর্ণ কেরানীগঞ্জের স্থানীয় লোকজনের বাধায় সেখান থেকে কেমিক্যাল পল্লী মুন্সীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিসিক কেমিক্যাল পল্লী ঢাকা শীর্ষক প্রকল্পটির নাম সংশোধন করে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সীগঞ্জ রাখা হয়েছে। অনুমোদনের এক বছরের কম সময়ের মধ্যে সংশোধন করা প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে আট গুণ। ১ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পের সংশোধনী অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে ওই একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প এলাকায় এখনও মাটি ভরাটের কাজ চলছে। এখনও সেখানে শুরু হয়নি প্রশাসনিক ভবন, পাম্প ড্রাইভার কোয়ার্টার, ফায়ার ব্রিগেড, সিইটিপি, ডাম্পিং ইয়ার্ড ও ইনসিনিরেটর নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, ড্রেন/কালভার্ট নির্মাণ, নলকূপ স্থাপন, পানি সরবরাহ লাইন, পুলিশ ফাঁড়ি, গ্যাস লাইন স্থাপন, জেটি নির্মাণ কাজ ইত্যাদি। বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সীগঞ্জ (১ম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পটি ১ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদন হয়। এর আগে জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। পরে প্রকল্পটি ‘ঢাকা বিসিক কেমিক্যাল পল্লী’ শিরোনামে ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২১ মেয়াদে বাস্তবায়নে জন্য একনেক থেকে অনুমোদিত হয়। পরে প্রকল্পের ১ম সংশোধনী একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। পরে দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও মেয়াদ বাড়ানো হয়।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের লক্ষ্যে মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার গোয়ালখালী, চিত্রকুট ও কামারকান্দা মৌজার ৩০৮ দশমিক ৩৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখানে ১ হাজার ৮৯৭টি শিল্প প্লট তৈরি করা হবে, এতে স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। গত ১২ নভেম্বর ২০২০ তারিখে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিত্রকুট মৌজায় ১৭৮.৭২ একর, গোয়ালখালী মৌজায় ১১৮.৬২ একর ও কামারকান্দা মৌজায় ১০.৯৯ একর, সর্বমোট তিনটি মৌজায় ৩০৮ দশমিক ৩৩ একর জমির লে-আউট প্ল্যান অনুযায়ী সরেজমিনে পরিমাপ করে প্রকল্প পরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
এ ছাড়াও ভূমি উন্নয়ন (মাটি ভরাট ও পুকুর খনন করে মাটি ভরাট) ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড বাংলাদেশ নৌবাহিনী, নারায়ণগঞ্জকে গত ১৩ এপ্রিল ২০২১ তারিখে প্রকল্পের লে-আউটসহ সাইট বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রেক্ষিতে ২৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখ থেকে প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ (ড্রয়িং, ডিজাইন ও সুপারভিশন সংক্রান্ত) প্রকল্পের সার্বিক পূর্ত কাজগুলোর প্রাক্কলন, ড্রয়িং, ডিজাইন ও সুপারভিশন কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সেবা ক্রয়ের লক্ষ্যে অ্যাকুমেন আর্কিটেক্টস অ্যান্ড প্ল্যানার্স লিমিটেডের সঙ্গে গত ৬ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে চুক্তি সম্পাদন করা হয়।
প্রকল্প কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রকল্প পরিচালক হাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় ২০২২ সালের জুলাইয়ে। কিন্তু কাজ শতভাগ শেষ না হওয়ায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে আগামী ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরান ঢাকা থেকে দ্রুত কেমিক্যাল গুদাম সরাতে নির্দেশ দিয়েছেন। কেমিক্যাল পল্লিতে জমি বরাদ্দ পেয়ে কেউ যেন অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করতে না পরে এ বিষয়ে সচেতন থাকারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী কেমিক্যাল পল্লী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজনের এক ইঞ্চিও বেশি জমি ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ নারী-পুরুষ ও শিশুর বেদনাদায়ক মৃত্যুর পরই ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ও দাহ্য রাসায়নিকের দোকান, কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। সেই নিমতলী ট্র্যাজেডির ৯ বছর পর ২০১৯ সালে ফের চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হয় পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় ৭১টি প্রাণ। এ দুর্ঘটনার পরপরই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হয়, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ও দাহ্য রাসায়নিকের দোকান, কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়া হবে। ঘোষণার পর ত্বরিতগতির তৎপরতাও শুরু হয়। ঢাকার বাইরে কেমিক্যাল পল্লী গড়ে তুলতে হাতে নেওয়া হয় প্রকল্প।
২০১৯ সালের জুনে শিল্প মন্ত্রণালয়ে জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত হয় মুন্সীগঞ্জ প্রস্তুত হওয়ার আগে সাময়িকভাবে রাসায়নিক কারখানা ঢাকার শ্যামপুরে উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে নেওয়া হবে। ছয় মাসের মধ্যে এগুলো স্থানান্তরের জন্য ব্যবসায়ীদের জায়গা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুই বছরে একটি রাসায়নিক কারখানাও সরেনি। কদমতলী থানার শ্যামপুরে বিসিআইসির উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে টঙ্গীর কাঁঠালদিয়ায় বিএসইসির খালি জায়গায় রাসায়নিক গুদাম সরাতে নেওয়া হয় প্রকল্প। এক বছরের মধ্যে যা বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু দুই বছর পরও সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিকভাবে দুটি স্থানে ১২ দশমিক ১৭ একর জমিতে ৪ লাখ বর্গফুট আয়তনের স্টিল শেড নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারি খরচে নির্মিত অবকাঠামোতে ব্যবসায়ীরা ন্যায্য ভাড়ায় রাসায়নিক পদার্থ রাখতে পারবেন।
বাংলা ট্রিবিউন
Leave a Reply